খুলনা | শনিবার | ১৯ জুলাই ২০২৫ | ৪ শ্রাবণ ১৪৩২

আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল : পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা, আসামি ৫৭৫, গ্রেফতার ১৬৬

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ আরও একজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ৫

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি |
০১:৩৮ এ.এম | ১৯ জুলাই ২০২৫


গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চৌরঙ্গী লঞ্চ ঘাট এলাকায় (কোর্টের সামনে) গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (২৮) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে তিনি মারা যান। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৫ জনে।   
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ ফারুক জানান, মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা আছে। রমজান মুন্সী গত ১৬ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। 
নিহত রমজান মুন্সির ভাই হিরা মুন্সি জানান, তার ভাই রিকশা চালাতেন। বুধবারের সংঘর্ষের সময় তিনি এক যাত্রীকে পৌঁছে দিতে রিকশা নিয়ে লঞ্চঘাট এলাকায় যান। তখন সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
রমজান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন হিরা মুন্সি। তিনি ভাইয়ের হত্যার বিচার দাবি করেন।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচজনের  মৃত্যু হলো। এর আগে গত বুধবার ঘটনার দিনই চারজন নিহত হন। তারা হলেন মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের দোকানি সোহেল মোল্লা (৩৫), পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা (২৫), সিরামিক পণ্যের দোকান কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭) ও রাজমিস্ত্রির সহযোগী রমজান কাজী (১৮)।
হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলায় আসামি ৫৭৫ : গোপালগঞ্জে এনসিপি জুলাই পদযাত্রা ঘিরে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উলে­খ করে মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপিনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বিশ্বাস নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উলে­খ এবং অজ্ঞাত সাড়ে ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে এ মামলা করেন। এসব তথ্য নিশ্চিত করেন গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এ্যান্ড অপস) ড. রুহুল আমিন সরকার। 
শুক্রবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং জানান, ১৬ জুলাই সকালে এনসিপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট আঞ্চলিক সড়কের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুরে পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। এ সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের নেতৃত্বে একদল লোক পুলিশের ওপর হামলা করে। তারপর তারা পুলিশ সদস্যদের মারপিট ও গাড়ি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পুলিশের পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বিশ্বাসসহ ৫ পুলিশ আহত হন।
এদিকে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। তাঁদের মধ্যে কতজনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, তা জানাননি ওসি।
ওসি সাজেদুর রহমান বলেন, সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের খাটিয়াগড় চরপাড়া এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা করে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ্বাস বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের জেলা শাখার সভাপতি নিউটন মোল­া, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উলে­খ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সদর থানার পরিদর্শক তদন্ত আবদুল­াহ আল মামুন জানান, গত বুধবার রাতে যৌথ বাহিনী ১৪ জনকে আটক করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। তাদের বুধবার বিকেলে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই ১৪ জনসহ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী।
গোপালগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার ১৬ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে ৫৪ ধারায় আদালতে নেওয়া হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গোপালগঞ্জে বুধবারের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেদিন প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ কামরুজ্জামান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাতেই গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, কারফিউয়ের সময় দ্বিতীয় দফায় আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর মধ্যে বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ আংশিক শিথিল থাকবে।
কারফিউর সময় বাড়লো : গোপালগঞ্জে কারফিউর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আজ শনিবার (১৯ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকবে। এর আগে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। বুধবার (১৬ জুলাই) রাত ৮ থেকে কারফিউ জারি করা হয়। এদিকে গোপালগঞ্জে এখন পর্যন্ত ১৬৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
কারফিউ শিথিলের সময় গোপালগঞ্জ শহরে বিভিন্ন যানবাহন চলতে দেখা যায়। জরুরি দরকারে গন্তব্যে যান মানুষ। মূল সড়কের পাশে ও গলির ভেতর বেশ কিছু দোকান খোলেন ব্যবসায়ীরা। তবে মার্কেটগুলো বন্ধ ছিল। বাজারের বেশির ভাগ দোকান খোলেনি।
শহরের বড় বাজারের ফল ব্যবসায়ী রতন সাহা বলেন, দোকান খুলতে না পারায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছি। তিনদিনে প্রায় ৩০ হাজার টাকার ফল পচে গেছে। শুক্রবার তিন ঘণ্টার জন্য দোকান খুলেছি। কিন্তু এ সময় আর কতটুকু বিক্রি করা যায়। আমরা চাই, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক।
এর আগে গত বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ। পুলিশের সঙ্গে চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ, জারি করা হয় কারফিউ। এখনো সেখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৬৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এর মধ্যে সদর তানায় ৪৫ জন, মুকসুদপুর থানায় ৬৬ জন, কাশিয়ানী থানায় ২৪ জন, টুঙ্গিপাড়া থানায় ১৭ জন এবং কোটালীপাড়া থানায় ১২ জন। তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে গত বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কের উন্মুক্ত মঞ্চে পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি পালন করতে যায় ছাত্রদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সেখানে সভা শুরুর আগে এক দফা হামলা চালায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ। 
এই হামলার পরও সমাবেশে যোগ দেন এনসিপির নেতারা। এরপর সমাবেশ শেষ হলে ফের তাদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। ভাঙচুর করা হয় নতুন এ দলটির গাড়িবহর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এগিয়ে গেলে তাদের উপরও হামলা হয়।
এরপরই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা পুলিশ সদস্যদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ে, ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয় পুলিশের গাড়ি।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগের চার কর্মীসহ পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। এছাড়া যৌথ অভিযানে আটক হয়েছে ২০ জন। এবার হলো পুলিশবাদী মামলা।
এদিকে সংঘর্ষের জেরে বুধবার থেকেই থমথমে গোপালগঞ্জ শহর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় শহর জুড়ে জারি করা হয় কারফিউ।
প্রথমে বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত চলে সরকার ঘোষিত ২২ ঘণ্টার কারফিউ। এরপর কারফিউয়ের মেয়াদ আরও বাড়ানো হয়। 
বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার (১৮ জুলাই) বেলা ১১টা পর্যন্ত জারি ছিল কারফিউ। ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা কারফিউ শিথিল করে সরকার। 
এরপর দুপুর ২টা থেকে ফের শুরু হয়েছে কারফিউ, চলবে বিকেল ৬টা পর্যন্ত। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বর্তমানে কারফিউয়ের আওতায় রয়েছে গোপালগঞ্জ।

্রিন্ট

আরও সংবদ