খুলনা | বুধবার | ২৩ জুলাই ২০২৫ | ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

সচিবালয়সহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ভাঙচুর, ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল নিক্ষেপ : আহত শতাধিক

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৩ এ.এম | ২৩ জুলাই ২০২৫


রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। দেরিতে অর্থাৎ গভীর রাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা। ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার এবং আগামী ২৪ জুলাই এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নতুন ছয় দফা দাবিকে সরকার যৌক্তিক বলে স্বীকার করে তদন্ত করা হবে জানিয়েছে। ঘটনার পর বরিশাল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। 
মঙ্গলবার সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের পদত্যাগের দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়ার পর ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভরত এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কেন রাত ৩টার দিকে ঘোষণা দিয়ে আজকের (মঙ্গলবার) এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হলো, তার জবাব দিতে হবে।’ 
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ফটকে এসেছে। যারা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের খাতা পুনঃমূল্যায়নের দাবিতেও সচিবালয়ের সামনে এসেছেন শিক্ষার্থীরা।
মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ভেতরে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সোমবার দিবাগত রাত ২টা ৪০ মিনিটে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এই তথ্য জানান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। 
এর আগে গত সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এফটি-৭ বিজিআই রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ভেতরে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের পাইলটসহ এখন পর্যন্ত মোট ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের কয়েকজন ছাড়া সবাই স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থী।
এদিকে ঢাকায় সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিকেলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় শতাধিক আহত হয়।
সচিবালয়ে আহত ৮৫ : বিভিন্ন দাবিতে মঙ্গলবার সচিবালয়ে ঢুকে পড়া শিক্ষার্থীদের বল প্রয়োগ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় তাদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এতে আহত হয়ে অন্তত ৮৫ জন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। মঙ্গলবার বিকেলে পৌনে ৪টার দিকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এর আগে বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে সচিবালয়ের এক নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা গাড়ি ভাঙচুর চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে ঢুকে ১০টির মতো গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হাজার হাজার শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও শিক্ষার্থীদের ছোড়া ঢিলে আহত হয়েছেন। এরপর শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টের দিকে অবস্থান নেন। জিরো পয়েন্টের দিকে পুলিশ কয়েক দফা সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
গুলিস্তানে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া : রাজধানীর গুলিস্তানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দ্বিতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়তে দেখা যায়। এ সময় পুলিশ ৮-১০টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং অন্তত দুজনকে আটক করতে দেখা গেছে।  
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংঘর্ষে প্রায় ৪০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বর্তমানে তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 
আহত শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা সচিবালযের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এতে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে শিক্ষার্থীরা আহত হন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মোঃ সুমন বলেন, “এত বড় বিপর্যয়ের পরও আজকের (মঙ্গলবার) এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত আসে গভীর রাতে। আমার ভাইবোনেরা আহত, কেউ কেউ মারা গেছে। আমরা এমনিতেই ট্রমার মধ্যে আছি। অথচ রাত ৩টার আগে কোনও ঘোষণা নেই। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগ চাই। তাই সচিবালয়ের সামনে এসেছি।”
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিস্তান এলাকায় সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয় ব্যবসায়ীরা।
আহত ৮০ জন ঢামেকে : শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগ দাবিতে সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে আহত ৮০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে আহতদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ ফারুক জানান, মঙ্গলবার বিকেলের দিকে আহত অবস্থায় একজন সাংবাদিকসহ আনুমানিক ৮০ জনকে জরুরি বিভাগে আনা হলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানিয়েছি।
৭ ঘণ্টা ধরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ শিক্ষার্থীদের : রাজধানীর উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলের হতাহত শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্য প্রদান ও গভীর রাতে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড এবং এর সামনের ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে অবরোধ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন দূর-দূরন্তের যাত্রীরা। শিক্ষার্থীরা বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সড়কের কিছু অংশ ছাড়লেও কিছুক্ষণ পর পুনরায় সড়ক আটকে দেওয়া হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭টায়ও শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান করছিলেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলাম বলেন, আমরা ন্যায্য দাবি নিয়ে এসেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত দাবি মেনে নেওয়া হবে না ততক্ষণ আমরা সড়ক ছাড়বো না। আমরা দেখেছি কীভাবে মাইলস্টোনে শিশুরা মারা গেছে। সেখানে কতজন নিহত হয়েছে তার সঠিক তথ্য দিচ্ছে না সরকার। আমরা আরও দেখেছি এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে ছলচাতুরি করছে। যেখানে সারা দেশ শোকে স্তব্ধ সেখানে শিক্ষা উপদেষ্টা আমাদের সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলছেন।
শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলেন, সরকারের আচরণও ফ্যাসিস্টের মতো হয়ে গেছে। কোনো কিছু বললেই পুলিশ, আর্মি পাঠায়। আমরা বলতে চাই হাসিনা দানব শিক্ষার্থীদের সাথে পারেনি। আর আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আমাদেরকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করা উচিত না।
তিনি বলেন, সাড়ে ৩টার দিকে আমরা সড়ক ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম ঢাকায় ছাত্রদের ওপর হাত তোলা হয়েছে। আমরা কারো রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না। শিক্ষা উপদেষ্টাকে চলে যেতে হবে। মাইলস্টোনে নিহত-আহতদের নির্ভুল তালিকা দিতে হবে। শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা সেনা সদস্যদের ক্ষমা চাইতে হবে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পুরনো বিমান বাতিল করতে হবে। সব দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত সড়ক ছাড়বো না।
এর আগে দুপুরে বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলে নিহত শিক্ষার্থীদের গায়েবানা জানাজা পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করা হয়।
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ ইউনুস আলী সিদ্দিকী জানান, পরীক্ষার বিষয়ে তারাও গভীর রাতে নোটিশ পেয়েছেন। নোটিশ পাওয়ার পর পরই সব কলেজে জানিয়ে দিয়েছেন।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাকির সিকদার বলেন, জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে সড়কে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। 
চট্টগ্রামে পদত্যাগের দাবিতে সড়ক অবরোধ : শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে নগরীর ষোলশহর এলাকার শিক্ষা বোর্ড ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ শুরু করেন তারা। এতে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
তাদের দাবি, শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবকে পদত্যাগ করতে হবে। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরও শিক্ষাসচিব পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা করেছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার কথা ভাবেননি।

্রিন্ট

আরও সংবদ