খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

গাজায় অপুষ্টিজনিত কারণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭ জনে

গাজায় অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ১ লাখ শিশু ‘৯ মাসে একটিও ডিম খাইনি’

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩১ এ.এম | ২৮ জুলাই ২০২৫


ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাবার-সংকট অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। উপত্যকাটিতে দুই বছরের কম বয়সী ১ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গাজার কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে হামলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
টানা ১১ সপ্তাহ অবরোধের পর মে মাসের শেষের দিক থেকে গাজায় খুব সামান্য পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এ ছাড়া ইসরায়েলে ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিতর্কিত ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে রয়েছেন।
গাজায় খাবার-সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা। উপত্যকাটির জনসংযোগ কার্যালয় থেকে শনিবার জানানো হয়েছে, ফর্মুলা দুধ সরবরাহ না করা হলে আসন্ন মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে দুই বছরের কম বয়সী ১০ লাখের বেশি শিশু। তাদের মধ্যে ৪০ হাজার শিশুর বয়স এক বছরের কম। ফর্মুলা দুধের অভাবে শিশুদের পানি খাওয়াচ্ছেন মায়েরা।
চরম দুর্দশায় রয়েছেন গাজার মায়েরাও। অপুষ্টির কারণে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না তাঁরা। এমনই একজন জয়নব। তিনি বলেন, ‘এই অনাহারের মধ্যেই আমি অন্তঃসত্ত¡া হয়ে পড়ি। যখন সন্তানের জন্ম দিই, তখনো অনাহারে ছিলাম। গত ৯ মাসে একটি ডিমও খেয়েছি কি না, মনে পড়ে না। এর বেশি আর কী বলবো?’
খাবারের এই হাহাকারের মধ্যে রোববার অনাহারে আরও পাঁচ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। 
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার ভেতরে তীব্র ক্ষুধা সংকট ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৭১ জন। একাধিক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টিজনিত কারণে। রোববার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
শনিবার আল-জাজিরাকে দেওয়া তথ্যে চিকিৎসা সূত্রগুলো জানায়, একদিনেই (শনিবার) গাজা জুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪২ জনই ছিলেন ত্রাণ সহায়তা পেতে মরিয়া মানুষ।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত মার্চে গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ শুরু পর থেকে এ নিয়ে অনাহার ও অপুষ্টিতে অন্তত ১২৭ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হলো। তাঁদের মধ্যে ৮৫ জনের বেশি শিশু। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি।
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ। উপত্যকাটিতে ‘ব্যাপক হারে দুর্ভিক্ষ’ ছড়িয়ে পড়ছে বলে গত বুধবার সতর্ক করেছিল শতাধিক মানবাধিকার সংস্থা। এছাড়া গাজায় দেখা দেওয়া ‘ভয়াবহ বিপর্যয়’ থামানোর জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহŸান জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি।
এএফপি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোববার গাজার কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে ‘কৌশলগত সামরিক কর্মকাণ্ড’ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা বলেছে, উপত্যকার আল মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ ও গাজা নগরীতে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হামলা চালানো হবে না। এ সময়ে জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো সড়ক পথে নিরাপদে ত্রাণ পাঠাতে পারবে।
এছাড়া গাজায় আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে বলে রোববার জানিয়েছে ইসরায়েল। উত্তর গাজায় এমনই একটি ত্রাণের বাক্স একটি তাঁবুর ওপর পড়ে অন্তত ১১ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। মিসর থেকেও রাফা ক্রসিং হয়ে ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আল-কাহেরা নিউজ।
এদিকে গাজাবাসীর জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) জাহাজ ‘হান্দালাকে’ বাধা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। রোববার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজটির আরোহীদের ‘অপহরণ’ করা হয়েছে। ওই সময় জাহাজটি গাজা উপকূল থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল। 
এই মানবিক বিপর্যয় ঘিরে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দার মুখে ইসরায়েল শনিবার রাতে ঘোষণা দেয়, রোববার থেকে তারা বেসামরিক এলাকাগুলো এবং ত্রাণ সরবরাহের করিডোরে ‘সাময়িক হামলা বিরতি’ দেবে।
তবে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করে বলেনি, কোন কোন এলাকায় এই বিরতি কার্যকর হবে।
ইসরায়েল বরাবরের মতো আবারও জাতিসংঘকে ত্রাণ বিতরণে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছে। তবে জাতিসংঘ এবং একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও সাহায্য সংস্থা এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, ইসরায়েলই যথাযথ অনুমতি না দেওয়ায় তারা নিরাপদে ত্রাণ পৌঁছাতে পারছে না।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা আকাশপথে ত্রাণ ফেলেছে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতও জানিয়েছে, তারা গাজায় অবিলম্বে আকাশপথে ত্রাণ পাঠাবে। কিন্তু মানবিক সহায়তা বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহ ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছাতে সড়কপথের বিকল্প হতে পারে না।
শনিবার জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি আকাশপথে ত্রাণ সরবরাহকে “মূল সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানো ব্যয়বহুল ও অকার্যকর উপায়” বলে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, এটি দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারবে না।
তিনি বলেন, “ইসরায়েলকে অবশ্যই অবরোধ তুলে নিতে হবে, রাস্তাগুলো খুলে দিতে হবে এবং মানুষের চলাচলের নিরাপত্তা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।”
গাজা শহর থেকে আল-জাজিরার হানি মাহমুদ জানান, ইসরায়েলের ঘোষিত পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত মাত্র সাতটি প্যালেটজাত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, যা মূলত একটি ট্রাক বা তারও কম পরিমাণে। এটি বাস্তবে কোনো সহায়তা নয়।”
তিনি জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এসব ত্রাণ উত্তর গাজার একটি সামরিক নিষিদ্ধ এলাকায় ফেলা হয়েছে, যেখান থেকে রাতে সেগুলো সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ইসরায়েলের ঘোষিত তথাকথিত ‘হিউম্যানিটেরিয়ান পজ’ বা সাময়িক বিরতিও বাস্তব সংকটের কোনো সমাধান নয় বলে উলে­খ করেন মাহমুদ।
তিনি বলেন, “এই পর্যায়ে এসে আমরা গণহারে ক্ষুধাজনিত মৃত্যু দেখতে যাচ্ছি, এটি নিশ্চিত করেছেন গাজার চিকিৎসা সূত্রগুলো।”
এদিকে ক্ষুধা যখন গাজা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তখনও থেমে নেই ইসরায়েলের প্রতিদিনের হামলা। শনিবার খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় একটি টেন্ট ক্যাম্পে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। এলাকাটি ইসরায়েলের ঘোষিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচিত হলেও সেখানেও অব্যাহত হামলা চলছে।
গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের অভাবে তাদের কোনো যানবাহন খুব শিগগিরই আর জীবনরক্ষামূলক সেবা দিতে পারবে না। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।
এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে হবে যাতে তারা জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ ঢুকতে দেয়।”

্রিন্ট

আরও সংবদ