খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

এআই প্রযুক্তির সহায়তায় রহস্য উদঘাটন

বিয়ামে এসি বিস্ফোরণ নয়, নথি পোড়াতে গিয়ে আগুনে পুড়ে নিহত হন দুজন

খবর প্রতিবেদন |
০৪:১৬ পি.এম | ২৮ জুলাই ২০২৫


চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের একটি অফিস কক্ষে ভোররাতে এসি বিস্ফোরণের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ওই বিস্ফোরণে একজন অফিস সহায়ক ও একজন গাড়িচালকের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। যা পরবর্তীতে গণমাধ্যমে খবরও হয়। তবে পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইঅ্যান্ডও) প্রায় তিন মাস তদন্তের পর বলছে, এসি বিস্ফোরণে নয় এটি একটি হত্যাকাণ্ড। উদ্দেশ্য ছিল নথি পোড়ানো। হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল না আসামিদের।

যদিও পেট্রোল ঢেলে নথিপত্র পোড়াতে গিয়েই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার জন্য কাজে চুক্তি হয় ১০/১২ লাখ টাকা।

পিবিআই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিকে শনাক্ত ও পরে গ্রেপ্তার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন— ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৬)।

গত ২৫ জুলাই তাদের কুড়িগ্রাম ও ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরে রাজধানী কল্যাণপুরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উত্তর (এসআইঅ্যান্ডও) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান।

তিনি বলেন, গত ২৭ জুলাই রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়ামের ভবন ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রচণ্ড শব্দসহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ওই কক্ষে রক্ষিত সমিতির দলিলপত্রাদি, নামজারি সংক্রান্তে কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাব, চেক বই, জমি ক্রয় সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র, কক্ষের এসি ইত্যাদিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

ঘটনার সময় অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক মো. ফারুক গুরুতর আহতের পর জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক (অবসরপ্রাপ্ত) সচিব মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন।

আব্দুর রহমান বলেন, হাতিরঝিল থানা পুলিশ দুই মাস মামলাটি তদন্ত করেন। থানা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে গত ৬ মে পিবিআই এসআইঅ্যান্ড (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার নিয়ে এসআই মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়।

পিবিআইয়ের বিশেষায়িত টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময়ের সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বিশ্লেষণে জানতে পারেন ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় অনুমান ৩০-৩৫ বছর বয়সি এক সন্দেহভাজন যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যায় এবং সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।

পিবিআইয়ের বিশেষায়িত টিম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের একাধিক টিমের চেষ্টায় আত্মগোপনে থাকা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামি আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্যমতে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে ঢাকার ভাটারার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলাম পিবিআইকে জানায়, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত বছরের ৫ আগস্ট ২/৩ মাস আগে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা ৫/৬ মাস রাখে।

জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে সে প্রায়ই বিয়াম প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতো এবং ওই অফিসের কাজে কয়েকজনের সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আ. মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করে।

পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদের ১০/১২ লাখ টাকা দেখার মৌখিক চুক্তি করে। পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন জাহিদ আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল স্লীপ শার্ট জামা কেনেন।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়। ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক চতুর্থ তলার ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে গাড়িচালক মালেক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।

পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আরও বলেন, আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলা নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক মালেক মারা যান। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইউনিট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড্রাইভার ফারুক মৃত্যুবরণ করলে জাহিদ আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলে।

জাহিদের কথামতো পরদিন তিনি রংপুর চলে যান। এই কাজে আশরাফুলকে ১০/১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও জাহিদ এখন পর্যন্ত তাকে ৬/৭ লাখ টাকা দিয়েছে।

গত ২৬ জুলাই বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার জাহিদুল ইসলাম এবং আশরাফুলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান আরও বলেন, আমরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আসামি শনাক্ত, তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামি দুজনকে গ্রেপ্তার করি।

্রিন্ট

আরও সংবদ