খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

এফআইআর ও তদন্তে নিয়মিত তদারকি : গায়েবি মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নির্দেশনা

অভিযানে ‘বডিওয়ার্ন’ ক্যামেরা বাধ্যতামূলক রিমান্ড স্বচ্ছ কাচের ঘরে

খবর প্রতিবেদন |
০৬:০৩ পি.এম | ২৮ জুলাই ২০২৫


কোনো অভিযানে গেলে পুলিশকে অবশ্যই জিপিএস ট্র্যাকিং ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস (বডিওয়ার্ন ক্যামেরা) যুক্ত পোশাক পরে যেতে হবে। এছাড়াও কোনো আসামিকে রিমান্ডে নিলে স্বচ্ছ কাচঘেরা নির্ধারিত কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। নারী আসামিদের যথাযথ শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালনের পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। স¤প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে কোনো আসামিকে আটক-গ্রেফতার, তল­াশি ও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে বিশদ সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। গ্রেফতার, তল­াশি ও জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১৬ সালের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ‘দণ্ডবিধি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি হয়েছে। সভায় এই অগ্রগতি তুলে ধরা হয় এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার তাগিদ দেওয়া হয়।
স্বচ্ছ কাচঘেরা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ : রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপযুক্ত আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ তৈরির নির্দেশনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়-আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ (ইন্টারগেশন রুম) অবশ্যই থাকবে। নির্মিতব্য ও নির্মাণাধীন থানায় এই কক্ষ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। বাকি থানাগুলোর ক্ষেত্রে গণপূর্ত অধিদফতরের সঙ্গে আলোচনা করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে সভায় জানানো হয়েছে। ভবিষ্যতেও যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অভিযানে বাধ্যতামূলক বডিওয়ার্ন ক্যামেরা : কোথাও অভিযানে বাধ্যতামূলক বডিওয়ার্ন ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে-অভিযান পরিচালনা করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ (বডিওয়ার্ন ক্যামেরা) ভেস্ট বা পোশাক পরিধান করতে হবে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে প্রতিটি সদস্যকে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ক্যামেরা সংযুক্ত বডি ভেস্ট পরিধান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে এ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সারাদেশে স¤প্রসারণের জন্য প্রায় ৪০ হাজার ইউনিট প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও তল­াশির সময় পুলিশ পরিচয় না দিলে বা সার্চ ওয়ারেন্ট দেখাতে ব্যর্থ হলে বা জব্দ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানানোর সুযোগ হিসেবে ৯৯৯ নম্বরকে আরও কার্যকর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আলাদা হেল্পলাইন চালুর পরিবর্তে জাতীয় জরুরি সেবার সক্ষমতা বাড়িয়ে তাতে এই সেবাগুলো সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
রাতের তল­াশিতে স্থানীয় প্রতিনিধির উপস্থিতির বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিশন। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যে গৃহ তল­াশির ক্ষেত্রে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে-প্রচলিত আইনে এমন বিধান রয়েছে। এর বাস্তব প্রয়োগে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এফআইআর ও তদন্তে নিয়মিত তদারকি : থানায় এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কার্যক্রম সার্কেল অফিসার ও পুলিশ সুপারের নিয়মিত তদারকিতে চলছে-এ তথ্য সভায় উপস্থাপন করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে- থানায় মামলা রুজু তথা এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার বা পুলিশ সুপার কর্তৃক নিয়মিত তদারকি জারি রাখতে হবে। কেইস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেফতার করা যাবে না।
এসব বিষয়ে থানায় মামলা রুজু তথা এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার বা পুলিশ সুপার কর্তৃক নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান। এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। আর এ বিষয়ে সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, প্রতিক্ষেত্রে কেস ডাইরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশক্রমে আসামি ধরতে হলে প্রকৃত অপরাধীর পালিয়ে যাওয়া অথবা ধরা না পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতি অধিক কার্যকর বিধায় তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এছাড়াও আদালতের আদেশ ছাড়া গ্রেফতার নয় এমন সুপারিশ করেছিল কমিশন। কোনো ব্যক্তিকে এফআইআরের বাইরে আসামি হিসেবে গ্রেফতার করতে হলে অবশ্যই আদালতের আদেশ লাগবে-এই সুপারিশের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, এতে অপরাধী পালিয়ে যেতে পারে, তাই প্রচলিত পদ্ধতিই কার্যকর। ফলে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
গায়েবি মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নির্দেশনা : কাউকে ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করেছে কমিশন। গায়েবি বা ভুয়া মামলায় নিরাপরাধ, মৃত বা প্রবাসী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হলে দোষী তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশও করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে-ভুয়া বা গায়েবি মামলায় অনিবাসী বা মৃত বা নিরাপরাধ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করতে হবে। অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা পরিহার করতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলায় হয়রানি করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এসবের পর্যালোচনায় বলা হয়, প্রচলিত আইনে এর বিধান রয়েছে। এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। টিআই প্যারেডের মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা আসামি শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর অপপ্রয়োগ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পুলিশ সদস্য কর্তৃক উদ্দেশ্যমূলক ভাবে অজ্ঞাতনামা আসামি করার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়াও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে অজ্ঞাতনামা আসামির নামে মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানি করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। টিআই প্যারেডের মাধ্যমে যথাযথ শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর সাক্ষ্য ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে কোনো ব্যক্তিকে মিডিয়ায় অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না-এই সুপারিশ প্রতিপালনের নির্দেশ পুনরায় দেওয়া হয়েছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ