খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

১৫০ দিন কোথায় ‘গায়েব ছিলেন’ মেজর সাদেক দম্পতি?

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৭ এ.এম | ০২ অগাস্ট ২০২৫


ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত আ’লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনে নানা চক্রান্তে লিপ্ত দলটি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে স¤প্রতি ঢাকায় গোপনে আ’লীগের ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।  
যেটি সমন্বয় করেন সেনাবাহিনীর মেজর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। সূত্র থেকে জানা যায়, এই চক্রান্তের মূলহোতা সাদেকুল হক সাদেক নামে ওই মেজর এবং তার স্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী সুপার (এএসপি) সুমাইয়া জাফরিন দুইজনই বিনা নোটিশে ১৫০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।  
এরই মধ্যে মেজর সাদেকুল হক সাদেক নামের ওই কর্মকর্তাকে আটক করে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী। ঘটনাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে একটি তদন্ত আদালতও গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়েছে। আইএসপিআর বলেছে, বিনা নোটিশে দেড়শ’ দিন কর্মস্থলে সাদেকের অনুপস্থিত থাকার বিষয়েও একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। দুই অভিযোগের বিষয়ে পূর্ণ তদন্ত শেষ হলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেজর সাদেক কক্সবাজারের রামু সেনানিবাসে কর্মরত রয়েছেন। সেখানে তিনি ৩৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফিজ ফেরদৌস তত্ত¡াবধানে ছিলেন। কিন্তু সাদেকের দেড়শ’ দিন বিনা নোটিশে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়টি সিও মুস্তাফিজও জানতেন না। এছাড়া সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন বাংলাদেশ পুলিশে এএসপি পদে কর্মরত। তিনিও বিনা নোটিশে ১৫০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, সাদেক ও সুমাইয়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার সময় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আওয়ামী ক্যাডারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন কলকাতায় থাকা আ’লীগের নানা পর্যায়ের নেতা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা।  
এর মধ্যে সার্বিক তত্ত¡াবধানে নাম আসছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের। তাকে সহযোগিতায় সেখানে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান পলাতক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমান।
আইএসপিআর যা বলেছে : শুক্রবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেজর সাদেককে আটকের বিষয়টি জানিয়ে বলেছে, স¤প্রতি একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক জনৈক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগটি প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জুলাই ওই সেনা কর্মকর্তাকে তার নিজ বাসস্থান রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে আটক করে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়।  
আইএসপিআর আরও জানায়, ঘটনাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। পূর্ণ তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেনা আইনে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করা হচ্ছে।
এছাড়া সাদেকের বিনা নোটিশে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে আইএসপিআর তাদের বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, তার কর্মস্থল থেকে অনুপস্থিত থাকা সংক্রান্ত ব্যত্যয়ের বিষয়ে অপর আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং তদন্ত শেষে আদালতের সুপারিশক্রম সেনা আইন অনুযায়ী দায় নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাশকতার জন্য দফায় দফায় প্রশিক্ষণ নেয় আ’লীগ ক্যাডাররা : সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণের জন্য কর্মশালার নামে গত ৮ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নেওয়া হয়। ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া ওই কনভেনশন সেন্টারে ওইদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আ’লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন এবং ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের প্রায় ৪০০ ক্যাডারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়াদের আগে থেকেই একটি টোকেন দেওয়া হয়। যা দুই দিন আগে মিরপুর ডিওএইচএস-এ একটি মিটিংয়ে আবেদনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। পূর্বের দেওয়া সেই টোকেন দেখিয়ে প্রশিক্ষণে জন্য প্রবেশ করে অংশগ্রহণকারীরা।  
এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে গত ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৮৩ নম্বর বাসা থেকে বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও একই সেক্টরের ১০/বি রোডের ১০ নম্বর বাসা থেকে গোপালগঞ্জের আ’লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেফতার করে ভাটারা থানা পুলিশ। শম্পার স্বামী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এছাড়া মেহেরপুরের যুবলীগ আহŸায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে এসব প্রশিক্ষণে সার্বিক সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
শুধু ভাটারা থানা এলাকায় নয়, রাজধানীর পূর্বাচলের সি-সেল রিসোর্টে, কাটাবনে ও মিরপুরে এলাকায় তিনটি প্রশিক্ষণের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রশিক্ষণে আওয়ামী ক্যাডারদের সশস্ত্র ও ভার্চুয়াল লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে ঢাকায় তিন থেকে চার লাখ নেতা-কর্মীর সমাগম ঘটিয়ে বিমানবন্দর ও শাহবাগ দখলের পরিকল্পনা ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের।
তদন্ত সংশ্লি¬ষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার সোহেল রানা ও শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে মুখোমুুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে মেজর সাদেকুল হক সাদেকের নাম। যিনি এসব প্রশিক্ষণে মূল সমন্বয়ের কাজ করেন। তার সঙ্গে এই নীল নকশায় জড়িত তার স্ত্রী এএসপি সুমাইয়া জাফরিন।
‘গুরুত্ব দিয়ে’ তদন্ত করছে পুলিশ : এদিকে গোপন এ বৈঠকের কথা জানাজানি হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। পুলিশ বলছে, আ’লীগের ক্যাডারদের ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বৈঠকের রহস্য উদঘাটনে এবং এর পেছনে জড়িতদের বের করতে ‘গুরুত্ব দিয়ে’ তদন্ত চলছে।  
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “আমরা বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখছি। এ ঘটনার অন্য কোনো দিক আছে কি না, এর প্রকৃত রহস্য কী এবং কারা কারা এর পেছনে দায়ী? ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত শিগগিরই উন্মোচন করার আশা করছি।”
এই বৈঠক এবং ৮ আগস্টের বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ‘হুমকির’ আলোচনা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তালেবুর রহমান বলেন, “আমরা গত একটা বছরে বিভিন্ন সময় দেখেছি, নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কার্যক্রম অনেকেই করেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা সজাগ রয়েছি।”

্রিন্ট

আরও সংবদ