খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন স্থানীয়দের অভিশাপ নানা সমস্যায় জর্জরিত কৈগরদাসকাঠিবাসীর জীবন

এস এস শোহান, বাগেরহাট |
০১:২৭ এ.এম | ০২ অগাস্ট ২০২৫


জন্ম থেকেই অবহেলিত এক জনপদ কৈগরদাসকাঠি। স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ভূমিহীন, হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষেরা আশ্রয় নেয় পশুর নদী সংলগ্ন রামপাল উপজেলার এই চরে। সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সুপেয় পানি, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা না থাকার সাথে মাদকের ছড়াছড়ি, বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদের মত সামাজিক সমস্যার মধ্যে জীবন-যাপন করতে থাকেন এখানকার বাসিন্দারা। এর সাথে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ১৪৫টি ভূমিহীন পরিবারকে দুই শতক জমিসহ আধাপাকা ঘর প্রদান করে সরকার। চরের স্থায়ী বিভিন্ন সমস্যার সাথে দেখা দেয় তীব্র কর্মসংস্থান সংকট।
এরই মধ্যে ২০১০ সালে গ্রামের পাশে বিলান জমিতে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বালু ভরাট করা হয়। তখন কৈগরদাসকাঠিসহ আশপাশ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নানা সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। মেগা প্রকল্প হওয়ায় অবহেলিত জনপদ কৈগরদাসকাঠির মানুষও আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে সেসব আশা নিরাশা হয়ে দেখা দেয় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। কারণ ১৮৩৪ একর জমির এই মেগা প্রকল্পে কৈগরদাসকাঠিসহ এলাকার মানুষের তেমন কর্মসংস্থান হয়নি। কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জের প্রভাবে স্থানীয়দের আয়ের প্রধান উৎস নদীতে মাছের পরিমাণ কমে গেছে। যার ফলে অনেক জেলে মাছ ধরা পেশা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মুরশিদা বেগম বলেন এখানে কোন কাজ নেই, তাই আমার স্বামী আমিনুর শেখ খুলনায় রিকশা চালান। আর আমি নদীতে মাছ ধরি। তবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ার পর থেকে নদীতে আগের মত মাছ পাই না। ওই খেয়ে না খেয়েই দিন যায় আমাদের। শুধু আমার স্বামী নয়, এলাকার অনেকেই মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে বড় শহরে থাকেন। 
ইরাদ আলী নামের এক জেলে বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা বছরই নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। তবে দিন দিন মাছ কমে যাচ্ছে। এখন দুই-তিন মাস মাছ ধরি। বাকি সময় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাই। তাতেও সংসার চলে না, কারণ রাস্তাঘাটও খুব খারাপ।
শুধু কর্মসংস্থানের অভাব নয়, এই চরে শিক্ষার সুযোগও খুব সীমিত, নিরাপত্তার অভাবে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেন অভিভাবকরা। তানিয়া আক্তার নামের এক মা বলেন, মেয়েরা একটু বড় হলেই আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। না হলে বখাটেরা খুব বিরক্ত করে। এই তো গতমাসে আমাদের পাশের ঘরের লাবনিকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিলো। বিয়ে না দিয়ে করবে কি, ফাইভ (৫ম শ্রেণি) পাস করার পর আর স্কুলেও দিতে পারেনি। কারণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসা অনেক দূরে। 
চরে থাকা একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কৈগরকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেকসনা বেগম বলেন, বর্তমানে ভর্তি থাকা ৭৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০-৪৫ জন নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে, অনেক সময় এর থেকেও কমে যায়। এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ার মত সব শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসে না। অভিভাবকদের দারিদ্রতা ও কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে বাচ্চাদের কাজে লাগিয়ে দেয়। অনেকে আবার শহরে পাঠিয়ে দেয়, যার কারণে এখানে ঝরে পড়ার হারও অনেক বেশি। 
এই চরের বাসিন্দাদের চিকিৎসা সংকটও প্রকট। পাশে মেঘা প্রকল্প তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও গড়ে ওঠেনি কোন চিকিৎসা কেন্দ্র। যার ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের নির্ভর করতে হয় মুদি দোকানের ওষুধের উপর। আর বড় অসুস্থতায় দীর্ঘ নদী পথে যেতে হয় দাকোপ ও রামপাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে সে পথও সুখের নয়।
নূরুন নাহার বেগম নামে এক নারী বলেন, এখানে জ্বর-সর্দীসহ নানা সমস্যায় আমরা মুদি দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাই। পেটের পীড়ায় একবার বেশ অসুস্থ হয়েছিলাম, সারারাত মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে সকালে হাসপাতালে যাই। জব্বার মলি­ক নামে এক বৃদ্ধকে গরুতে আক্রমণ করেছিল, তিন ঘন্টায়ও হাসপাতালে নেওয়ার কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় রক্তক্ষরণে সন্ধ্যার পরে মারা যায়।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজ তামান্না ফেরদৌসি বলেন, স¤প্রতি আমি এই উপজেলায় যোগদান করেছি। কৈগরদাসকাঠিসহ বিভিন্ন আশ্রয়ন প্রকল্পের মানুষরা নানা কষ্টে আছে। তবে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করা হয়। সেটা চাহিদার তুলনায় কম। আমরা কৈগরদাসকাঠি পরিদর্শন করবো। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোট ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংকট নিরসনের চেষ্টা করবো। 
 

্রিন্ট

আরও সংবদ