খুলনা | বুধবার | ০৬ অগাস্ট ২০২৫ | ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

সাগর দূষণ-পানির প্রবাহ বদলে কমছে ইলিশ

খবর প্রতিবেদন |
০১:৪৪ এ.এম | ০৩ অগাস্ট ২০২৫


প্রতি বছর ভরা মৌসুমে সাগরে ইলিশ না পেয়ে পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জেলেরা। মিরসরাইয়ের সাহেরখালী পয়েন্ট দেশের ৫টি প্রজনন ক্ষেত্রের একটি হলেও এই পয়েন্ট ঘিরে জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠায় মাছের বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন করেছে। এই কারণে আগের মত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজান থেকে নেমে আসা মিঠাপানির প্রবাহ ও গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চলে ইলিশ কমে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ বছরে বদলে গেছে ইলিশ আহরণের চিত্র। ইলিশের মৌসুম চললেও সাগর থেকে যেন মাছ উধাও। ৫ বছরে মিরসরাইয়ে ইলিশ আহরণ কমেছে ২২৭ মেট্রিক টন। কিন্তু ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার বছরে একাধিকবার সাগর ও নদীতে মাছ আহরণ বন্ধ রেখেও কেন বাড়ছে না তা এখানকার জেলেদের বোধগম্য নয়। তবে জেলেদের ধারণা, মিরসরাইয়ের চরে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ইলিশ আহরণ কমতে পারে। মিরসরাই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মিরসরাইয়ে ২৯টি জেলে পাড়ায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে দুই হাজার ৫৫৭ জন। পরিবার রয়েছে প্রায় ৫ হাজার।
‘আগে যেভাবে উপক‚লে ইলিশ পাওয়া যেত এখন সেভাবে পাওয়া যায় না। এটার প্রধান কারণ হচ্ছে ইলিশ উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ঘাটগুলো বদলে ফেলায় ইলিশ আহরণ কমেছে। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, মিরসরাইয়ে ২০২০ সালে ইলিশ আহরণ হয় ৩২৭.৪ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০২১ সালে এসে ইলিশ আহরণে ধাক্কা খায় এখানকার জেলেরা। ওই বছর ইলিশ আহরণ হয় ২৫২.৩ মেট্রিক টন। এভাবে প্রতি বছর ইলিশ আহরণ কমতে থাকে। ২০২২ সালে আহরণ হয় ১৪৭.৪ মেট্রিক টন ইলিশ। কিন্তু সেই ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেনি মিরসরাইয়ের ২৯টি জেলে পাড়ার কয়েক হাজার জেলে। ২০২৩ সালে আহরণ হয় ১১৬ মেট্রিক টন ইলিশ। ২০২৪ সালে ইলিশ আহরণ নেমে যায় তলানিতে। ওই বছর আহরণ হয় মাত্র ৩৬ দশমিক ৪৯ টন।
ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর হয়ত আরো ৪৪ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হলে মোট আহরিত ইলিশের পরিমাণ হবে ১০০ টন। ফলে বিগত ৫ বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ কমেছে ২২৭ মেট্রিক টন।
ডোমখালী জলদাশ পাড়ার জেলে রতন জলদাশ জানান, তার ৬ সদস্যের সংসার। প্রত্যেক বছর ইলিশের মৌসুম এলে দাদনে জাল ক্রয় করেন। পরে ইলিশ মাছ আহরণ করে সেই দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ইলিশ মাছ আহরণ কমে যাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ করতে স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এছাড়া বছরে দুইবার মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে।
উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের আনন্দবাজার এলাকার জেলে জদু জলদাশ বলেন, ইলিশ এখন সোনার হরিণ। সাগর ও নদীদূষণ বেড়ে গেছে। তাই ইলিশ মাছ দিনদিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি ভরাট কাজে বড় বড় ড্রেজার ব্যবহৃত হওয়ায় কারণেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘ইলিশ এখন সোনার হরিণ। সাগর ও নদীদূষণ বেড়ে গেছে। তাই ইলিশ মাছ দিনদিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি ভরাট কাজে বড় বড় ড্রেজার ব্যবহৃত হওয়ায় কারণেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।’ একই এলাকার অজয় জলদাশ বলেন, সাগরে আগের মত মাছ না পাওয়ায় এখন আর সাগরে মাছ ধরতে যাই না। এখন কৃষি কাজ করছি। অনেকটা বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজান থেকে নেমে আসা মিঠাপানির প্রবাহ ও গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, সাগরে ইলিশের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে ব্যাঘাত এবং পূর্ববর্তী বছরের অতিরিক্ত আহরণকে ইলিশ কম পাওয়ার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বর্জ্যসহ নানা কারণে ইলিশের পরিমাণ কমছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ হারুনর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে নদীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ইলিশের প্রজনন ও আবাসস্থলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
‘নদীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ইলিশের প্রজনন ও আবাসস্থলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ডুবোচর তৈরি হওয়া ও নদীর তীরে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কারণে মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ও উৎপাদন প্রভাবিত হচ্ছে। সাগর থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজিংয়ের কারণেও ইলিশের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
ডুবোচর তৈরি হওয়া ও নদীর তীরে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কারণে মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ও উৎপাদন প্রভাবিত হচ্ছে। সাগর থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজিংয়ের কারণেও ইলিশের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, এ বছর জেলেদের জালে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়েনি। ইলিশের আহরণ কমে যাওয়ার বিষয়ে মৎস্য বিভাগ চিন্তিত। আগে যেভাবে উপক‚লে ইলিশ পাওয়া যেত এখন সেভাবে পাওয়া যায় না। এটার প্রধান কারণ হচ্ছে ইলিশ উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ঘাটগুলো বদলে ফেলায় ইলিশ আহরণ কমেছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ