খুলনা | মঙ্গলবার | ১২ অগাস্ট ২০২৫ | ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২

৪ আগস্ট ২০২৪ : ফ্যাসিবাদের পতনের ঘণ্টা বাজে খুলনা থেকে

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:২৬ এ.এম | ০৪ অগাস্ট ২০২৫


পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের ঘণ্টা এক দিন আগে বেজে যায় খুলনা থেকে। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সারাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতার সঙ্গে দেশের সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ। বাংলাদেশ তথা পাকিস্তান সৃষ্টির একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বরাবরই খুলনাকে নিয়ে একটি মিথ ছিল। কেননা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৪ আগস্ট। কিন্তু তখনও খুলনা-যশোর পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল না। তবে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা সাবেক কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুর খানের দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা হয় খুলনাকে পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে। দিনটি ছিল দুই দিন পর ১৭ আগস্ট। 
তেমনি ভাবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় বিজয় দিবসেও খুলনা শত্র“ মুক্ত হয়নি। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে পাক অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন খুলনার শিরোমনিতে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমল যুদ্ধ চলছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলে শিরোমনি যুদ্ধ আজও বিশ্বের অন্যতম সম্মুখ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। শিরোমনি যুদ্ধে বিজয়ী হন মুক্তিযোদ্ধা। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর খুলনা শত্র“ মুক্তি হয়। এরপর থেকে ইতিহাসের পাতায় খুলনাকে একদিন পরের স্বাধীনতা বা বিজয় বলা হয়। অনেকে কটাক্ষ করেন রসিকতার ছলে। তবে সে আক্ষেপ পূরণ হয়েছে গত বছর স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের পাতায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন হলেও শুরুটা হয়েছিল তার আগের দিন খুলনা থেকে।
ফিরে দেখা ৪ আগস্ট-২০২৪ খুলনা : ৪ আগস্ট ২০২৪, এই দিন খুলনার শিববাড়ি মোড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ শুরু করে সকাল থেকে। তার আগে ২ আগস্ট শুক্রবার জুমআর নামাজের পর নগরীর নিউমার্কেট ও শিববাড়ি মোড় থেকে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। পথে মজিদ সরণীতে পুলিশ প্রথমে বাধা দিলেও ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সেটি ব্যর্থ হয়। পরে সোনাডাঙ্গা থানা অতিক্রম করার সময় পুলিশ দ্বিতীয় দফা বাধা দেয়। তার পরেও মিছিলটি এগিয়ে যেতে থাকে গল­¬ামারীর দিকে। অপর দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এদিকে গল­¬ামারীতে শিক্ষার্থীদের মিছিলটি গল­ামারী ব্রিজ অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে যোগ দিতে গেলে আবার বাধার মুখে পড়ে। পরে জিরো পয়েন্ট ছেড়ে খুবি গেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। মাঝখানে পুলিশের বিশাল একটি রায়ট টিম অবস্থান নেয়। অপর দিকে জিরোপয়েন্ট এলাকায় পুলিশের অপর একটি দাঙ্গা দল অবস্থান নেয়। দুই দিক থেকে পুলিশ ছাত্র-জনতাকে ছত্র ভঙ্গ করার জন্য সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার সেল ও গুলি বর্ষণ করতে থাকে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলা এ যুদ্ধ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় লুকিয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবল সুমন বের হয়ে আসলে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে গণপিটুনিতে কনস্টেবল সুমন নিহত হয়। এ ঘটনার পর ২ আগস্ট রাত থেকে খুলনার রাস্তায় কোনো পুলিশকে ডিউটি করতে দেখা যায়নি। এমনকি পরের দিন ৩ আগস্ট পুলিশের কোনো টহল টিমও বের হয়নি। রাস্তায় বিজিবি আর সেনা সদস্যদের টহল চলে। শনিবার ৩ আগস্ট ছাত্ররাও কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি।
পরের দিন পুলিশ শূন্য নগরীতে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। সকাল ১০টার দিকে আ’লীগ তার সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নিয়ে শামীম স্কয়ার মাকের্টস্থ দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হয়। সেখানে সাবেক মেয়র ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অবস্থান করছিলেন। অপর দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিক্ষুব্ধ জনতা পিকচার প্যালেস মোড়, ডাকবংলা মোড়, স্যার ইকবাল রোডসহ আশে-পাশে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও খুলনা সদর থানা আ’লীগের সভাপতি এড. মোঃ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মিছিল আদালত চত্বর হয়ে শহিদ হাদিস পার্কের সামনে আসলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। এ সময় এড. মোঃ সাইফুল ইসলাম তার নিজের শর্টগান দিয়ে গুলি ছুঁড়লে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। একই সময় দলীয় কার্যালয় থেকে আ’লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের কাছে থাকা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু জনতার প্রতিরোধে আ’লীগের নেতা-কর্মীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় আ’লীগের অফিসের নিচে জনতার হাতে গুরুতর আহত হন মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনসহ বেশ কয়েকজন নেতা। তাদেরকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় একই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা খুলনার বহুল আলোচিত শেরে বাংলা রোডস্থ শেখ বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে। এই বাড়িটি খুলনার গণভবন মনে করতেন অনেকে। কেননা এই বাড়িটি ছিল পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসেরের বাড়ি। যে বাড়িতে থাকতেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন, তার ছেলে সাবেক এমপি শেখ তন্ময়, শেখ হেলালের মেঝ ভাই সাবেক এমপি সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, অপর ভাই শেখ সোহেল ও শেখ রুবেল। আলোচিত শেখ বাড়িটি ছিল খুলনা বিভাগ তথা দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, টেন্ডারবাজিসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের সকল অপকর্মের কন্ট্রোল রুম। 
একই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা খুলনা প্রেসক্লাবে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। ৪ আগস্ট দিনে-রাতে তিন দফায় বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে ক্ষুব্ধ জনতা। ওই দিন সাবেক মেয়র রাতে নিজ বাড়িতে থাকলেও সেখানেও চড়া হয় ক্ষুব্ধ জনতা। ওই সময় তিনি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অথচ তার একদিন আগেই পুলিশ তাদের নিরাপত্তায় ছিল। এটি ছিল ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে দেশের প্রথম বিজয়। যেটি একদিন আগেই খুলনা থেকে তার পতনের ঘণ্টা বেজে যায়।

্রিন্ট

আরও সংবদ