খুলনা | বুধবার | ১৩ অগাস্ট ২০২৫ | ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২

১১ মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১ মামলা হয়েছে : টিআইবি

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩০ পি.এম | ০৪ অগাস্ট ২০২৫


গণ-অভ্যুত্থানে হত্যায় জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। সরকার পতন-পরবর্তী ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলায় আসামি এক হাজার ১৬৮ পুলিশ। এর মধ্যে ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

আরও জানানো হয়, কিছু কিছু বিভাগীয় পদক্ষেপের বাইরে বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর জবাবদিহির অগ্রগতি না থাকা-সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতি দেখা গেছে।

আজ সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশ : কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছরের ওপর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা জানানো হয়।

টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, হত্যার ইন্ধনদাতা ও নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা দায়ের হয়েছে। দায়েরকৃত মামলা এক হাজার ৬০২টি (হত্যা মামলা ৬৩৮টি) পতিত সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আনুমানিক ৮৭ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন। ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে ‘সন্তোষজনক অগ্রগতি’ রয়েছে। ৬০-৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে।

তিনি আরও বলেন, এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরমধ্যে অভিযোগ ৪২৯টি ও মামলা ২৭টি। শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জন। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের আগেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে ধীরগতি আছে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া চলমান আছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি বলেছে, অবস্থা এমন যে, অনেক ক্ষেত্রেই জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাহীন রয়ে গেছে। যা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরেনি:
অর্থনৈতিক খাতে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি নেই উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, বাড়েনি কর্মসংস্থান; বিনিয়োগেও রয়েছে স্থবিরতা। রিজার্ভ বাড়লেও কাঠামোগত চাপ রয়েছে, আর প্রকৃত অর্থে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখনও সীমিত। ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি থাকলেও এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণ খেলাপি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। এমনকি কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের তিন খাতেই লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে।

কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন নিয়ে প্রশ্ন:
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলেও সরকারের প্রকৃত কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তুলে টিআইবি জানিয়েছে, সরকারে তথ্য প্রকাশে সমন্বয়হীনতা ও গোপনীয়তার প্রবণতা রয়েছে। ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণের ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সংকট ও তার ফলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত।

রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যবেক্ষণে অগ্রগতি সম্পর্কে টিআইবি বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান ও সহায়তার অঙ্গীকার রয়েছে। দুর্নীতি দমনে সহায়তার ঘোষণা, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার, দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন ও তদন্ত চলমান। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে মানবাধিকারের সুরক্ষা, সংখ্যালঘু সুরক্ষা, সহিংসতার ঘটনার পূর্ণ এবং স্বাধীন তদন্তের প্রয়োজনীয়তা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় অগ্রগতি কথাও বলা হয় এতে।

টিআইবির পর্যবেক্ষণে সরকারের ঘাটতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান ও তথ্য প্রকাশে ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ; সীমান্তে হত্যা ও ‘পুশ ইন’ অব্যাহত; বাণিজ্যে বাধা আরোপ; কূটনৈতিক টানাপোড়েন; শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানোও সরকারের ঘাটতি বলে মনে করে টিআইবি।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি:
টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা চলছেই। পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ পেশাদারিত্বের ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গত এক বছরে পুলিশে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- অব্যাহতি, পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলি। পুলিশ বাহিনীতে মৌলিক সংস্কারের পরিবর্তে কেবল পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলির বিষয়ে মনোযোগ ছিল।

তিনি আরও বলেন, ২০২৫ এর ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করে ২১ দিনে সারা দেশে ১২ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছে।

টিআইবির ফেলো বলেন, আন্দোলনে নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তির পতন হয়েছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতায় (মব জাস্টিস) গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার আশঙ্খাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ‘মব’ তৈরি করে দাবি আদায়ের প্রবণতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাবি আদায়ে সফল হয়েছে।

শাহজাদা এম আকরাম বলেন, ঢালাওভাবে মামলায় আসামি হিসেবে নাম দেওয়া, গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তার বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমে বৈষম্য কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন লক্ষ্য করা গেছে।

এনসিপি আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে:
টিআইবি বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ হিসেবে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি এনসিপির বিকশিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থের উৎসের অস্বচ্ছতা, দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়মের বিদ্যমান সংস্কৃতি ধারণ করে আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে দলটি।

টিআইবির গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন বলেন, নির্বাচনের তারিখ, সংস্কার ও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিতর্ক ও সহনশীলতার ঘাটতিতে সংস্কার ও নির্বাচন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন-সংস্কার-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে মুখোমুখি দাঁড় করানোতে রাজনৈতিক দলগুলোর অনড় অবস্থান আছে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন রাজনৈতিক মতাদর্শিক লড়াই-ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। একাংশ কর্তৃক রাজনৈতিক দল গঠন (জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি) করেছে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ, পুরাতন জোট ভেঙে নতুন নতুন রাজনৈতিক জোট বা বলয় তৈরির উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ও নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা পরেছে। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে কোনো দলের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নামসর্বস্ব দল। এছাড়া এনসিপির নিবন্ধনের শর্ত পূরণে ব্যর্থতা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ফেলো মো. জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

্রিন্ট

আরও সংবদ