খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০৭ অগাস্ট ২০২৫ | ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাই অভ্যুত্থান : রচিত হোক স্বপ্নের বাংলাদেশ

|
১২:০৯ এ.এম | ০৫ অগাস্ট ২০২৫


দীর্ঘ ১৭ বছরের এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশের জনগণ যখন মুক্তি চাচ্ছিল, যখন আমি-তুমি ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক মারা হলো ঠিক তখনই অন্ধকারের মাঝে আলো নিয়ে এলো আমাদের দেশের তরুণ সমাজ, ছাত্রসমাজ। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান, পাল্টে দিয়েছিল সব হিসাব-নিকাশ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। শেখ হাসিনা ও আ’লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে এ গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সৃষ্টি হয় স্বপ্নের বাংলাদেশ। যে স্বপ্ন বাস্তবে রূপদানে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে রচিত হয়। শেখ হাসিনা স্বৈরশাসকের মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও সরকারের দমন পীড়ন, হত্যা, নির্যাতনে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। কোটা আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
আ’লীগের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি করেছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পরপর তিনটি নিয়ন্ত্রিত ও একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমশ নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে একচেটিয়া কর্থর্তৃত্ব কায়েম করে সব রকমের বিরোধী মত ও কার্যক্রম কার্যত রুদ্ধ করে দেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গায়েবি মামলা ইত্যাদি আইনি-বেআইনি নিষ্পেষণে দেশ ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়। বিরোধী মতের প্রকাশ হয়ে ওঠে অপরাধ, গণমাধ্যম নজিরবিহীন আক্রমণের শিকার হয়, রাজনৈতিক নিগড়ে বাধা পড়ে বিচারব্যবস্থা।
দীর্ঘ ১৭ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন ফ্যাসিবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের সবৃস্তরের মানুষকে এক কাতারে আনতে পারলো না সেখানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মাত্র একমাস আন্দোলন আর রক্তপাতের পর পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। জয়ী হয় ছাত্র-জনতা। এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেশের মানুষ।
ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটাতে সক্ষম হলেও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সম্পূর্ণ বিলোপ এখনো সম্ভব হয়নি। ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ ঘটাতে না পারলে জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন ছিনতাই হয়ে যেতে বাধ্য। আর তা যদি ছিনতাই হয়ে যায় তাহলে সমগ্র জাতিকে কঠিন মাশুল দিতে হবে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন মানেই ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থার পতন নয়। ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে হলে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে ফ্যাসিবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
জুলাই। মাসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, যা গত জুলাইয়ের পূর্বেও আলোচনায় ছিল না। জুলাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কারণ, জুলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব, জনগণের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। গত বছরের আজকের এ দিনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে এক উত্তপ্ত জুলাইয়ের গল্প। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের শুরু হয়েছিল এ জুলাইয়ে। অকুতোভয় ছাত্র-জনতা, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স সব ভেদাভেদ মুছে দিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধ নাড়িয়ে দিয়েছিল স্বৈরশাসকের ভিত্তিমূল। যার ফলে আজকের এ জুলাই, একটি নতুন সূর্য।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক অনন্য বীরত্বের সংগ্রাম ও সংগ্রামের বিজয় অর্জন করতে পারার ইতিহাস রয়েছে। যা অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে ইতিহাস একই সঙ্গে অর্জিত বিজয় ধরে রাখতে না পারারও ইতিহাস রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারার পরও মানুষের মাঝে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সেসব কারণেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মাঝে নানা রাজনৈতিক বিষয়, এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনাকল্পনা, আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। সেসব বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
আমাদের দেশে ইতিহাসে আপেক্ষিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়। সেটিই ছিল জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর জাতীয় ঐক্য। ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে, অবহেলা করে, কিংবা তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কোনো জাতীয় ঐক্য হলে তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ১৯৭১ পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জুলাই ২৪-এ ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে।
আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতভাবেই ছিল একটি জনযুদ্ধ। সেটি নিছক কোনো কোনো মাস্টারমাইন্ডের পরিকল্পনার ফসল ছিল না। সেটি ছিল না কেবল একটি ৯ মাসের সামরিক অপারেশন। তা ছিল বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে পরিচালিত গণমানুষের অসংখ্য গণসংগ্রামের সফল পরিণতি। ৯ মাসের অসীম সাহসী সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল তার শীর্ষ অধ্যায়। এ লড়াই কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কার্যকলাপ ছিল না, তা ছিল বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’-এর ধারায় পরিচালিত এক অনন্য সংগ্রাম। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণমানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন।
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ঠিক এক বছর পরের জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের চেতনে কিংবা অবচেতনে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির এক ধরনের হিসাব-নিকাশের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ এক বছর চলে গেলেও আমরা আজও কি আমরা এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারিনি, শেখ হাসিনার পতন আমরা কেন চেয়েছিলাম? পতনপরবর্তী সময়ে আমাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ভবিষ্যতে এ ধরনের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পেরেছি কি আমরা?
হাজার হাজার আন্দোলনকারীর আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসকের বিদায় হলেও জনগণের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এক বছরেই দেশে ক্রমান্বয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তার মধ্যে নতুন ফ্যাসিবাদের আগমন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পুরো সমাজের মধ্যে আবার একটা নতুন ফ্যাসিবাদী শক্তির নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এখনই প্রতিবাদ করতে হবে। তা না হলে গণঅভ্যুত্থানের অর্জন ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের আজ্ঞাবহতা বর্জন করে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের পথে ফিরে আসতে বাধ্য করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন মানেই ফ্যাসিবাদ ব্যবস্থার পতন নয়। ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করতে হলে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে ফ্যাসিবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ