খুলনা | রবিবার | ১০ অগাস্ট ২০২৫ | ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

জড়িত পুলিশ-র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার অনেক কর্মকর্তারা এখনো অধরা

বছর জুড়ে আলোচনায় আয়না ঘর

খবর প্রতিবেদন |
০১:০২ এ.এম | ০৯ অগাস্ট ২০২৫


জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে ‘আয়নাঘর’-যা বর্তমানে জোরপূর্বক গুমের প্রতীকমাত্র নয়, বরং বাংলাদেশের মানবাধিকার সংকটের এক ভয়াবহ চিহ্নে রূপ নিয়েছে।
এই ‘আয়নাঘর’ বা ‘গুমখানা’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সদস্য। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের বেশির ভাগই এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যথাযথ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় না আনলে তারা ভবিষ্যতেও গুরুতর অপরাধে জড়িত হতে পারে।
২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৬০৫ জনকে গোপনে আটক বা গুম করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় নিখোঁজ হন ৪০২ জন। এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত গুমের শিকার হন ৩৪৪ জন, যাদের মধ্যে ৪০ জনকে মৃত অবস্থায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে এবং ২০৩ জনকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেসব গুমভুক্ত মানুষ ফিরে এসেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। দিনের পর দিন, এমনকি মাসের পর মাসও চোখ বেঁধে একটি অজ্ঞাত ও গোপন স্থানে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল-যেখানে দিনের আলো প্রবেশ করে না, চারপাশে নীরবতা, আর ছিল সীমাহীন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এই অমানবিক জায়গার নামই এখন ‘আয়নাঘর’।
এখানে আটক থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, সামরিক কর্মকর্তা আবদুল­¬াহিল আমান আজমি এবং ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আয়নাঘর ছিল সিসিটিভি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণাধীন ক্ষুদ্র কক্ষ। সেখানে নড়াচড়া করাও কঠিন ছিল, সারাক্ষণ কৃত্রিম আলোয় ঘেরা সেই কক্ষে দিনের-রাত্রির পার্থক্য ছিল না। খাবার দেওয়া হলেও তা ছিল অপ্রতুল। কথা বলার অনুমতি ছিল না, এবং নির্যাতনের ধরণ ছিল বিভীষিকাময়।
একটি গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উলে­খ করা হয়, এসব আয়নাঘরের সেলগুলোতে টয়লেট প্যান শোবার জায়গার এতটাই কাছে ছিল যে শুয়ে থাকলে শরীর প্রায়শই তার ওপর পড়ে যেত। ফলে বন্দিরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার জন্য বাধ্য হতেন।
একজন ভুক্তভোগী, যিনি ২০১৫ সালে ডিজিএফআই ও র‌্যাবের আয়নাঘরে ৩৯১ দিন আটক ছিলেন, তিনি বলেন-“ঘুমাতে গেলেই বলা হতো, ‘এই ঘুমাইতেছেন কেন?’ মানে ঘুমাতে দিতো না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বালিশ-কম্বল সরিয়ে নিত। শীতের মধ্যে এসব ছাড়া থাকতে হতো। মশার কামড়ে কষ্ট পেতাম। কখনও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বিছানার পাশে আটকে রাখত, চেয়ার ছাড়া বসায় রাখতো।”
ফেরত আসা ব্যক্তিদের ভাষ্য মতে, আয়নাঘর স্থাপন করা হয়েছিল ডিজিএফআই ভবনের পাশের ভবন, র‌্যাব সদর দফতর, র‌্যাব-১ কার্যালয়, সেনা-নিয়ন্ত্রিত এলাকা এবং বনানী, গুলশান, মিরপুরসহ আশপাশের কিছু ভবনের বেজমেন্টে।  
সূত্রমতে, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছিলেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউল আহাসান। তার বিরুদ্ধে বহু ব্যক্তি গুম, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যেসব আলোচিত গুম-খুন হয়েছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাজেদুল ইসলাম সুমন, আদনান চৌধুরী, কাওসার আহমেদ, ইফতেখার আহমেদ দিনার ও জুনায়েদ তাদের অধিকাংশ ঘটনায় জিয়াউল আহসানের সংশ্লি¬ষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ।
দীর্ঘদিন এসব অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনি ছিলেন ক্ষমতাধর অবস্থানে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। এমনকি ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি নিজের ফেসবুক আইডি থেকে সরকারের পক্ষে পোস্ট দেন। সরকার পতনের পর সেই পোস্টগুলো মুছে ফেলেন।
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, আয়নাঘরের অস্তিত্ব উদ্ঘাটন এবং এর সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনাই হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার পূর্বশর্ত।

্রিন্ট

আরও সংবদ