খুলনা | রবিবার | ১০ অগাস্ট ২০২৫ | ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

ঘুরে দাঁড়িয়েছে রিজার্ভ, কমেছে মূল্যস্ফীতি

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৩ এ.এম | ০৯ অগাস্ট ২০২৫


ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল লুটপাটের শিকার দেশের ব্যাংকিং খাত ঠিক করা। এ খাতে গত এক বছরে সরকারের সাফল্য অনেক। রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড গড়া এবং খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচনে ফিরে এসেছে জনআস্থা।
২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকখাত সংস্কারে গঠন করা হয় একটি টাস্কফোর্স। এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং টেকসই সমাধানের পথ তৈরি করা।
কোভিড পরবর্তী সময়ে অতিমাত্রায় আমদানি ব্যয় ও অর্থপাচারের কারণে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রিজার্ভ দ্রুত নামতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ দাঁড়ায় মাত্র ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে এক বছরে রিজার্ভ বেড়ে ২৫ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৩০ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে বড় কোনো পরিশোধ করতে হয়নি, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন অতিরিক্ত ডলার কিনে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করছে।’
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ যেখানে ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গিয়েছিল, সেখানে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তা ৩০ বিলিয়নের বেশি হয়েছে, এটা এক বিশাল অর্জন।’
রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড : ড. ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পরই প্রবাসীদের আস্থা ফিরতে শুরু করে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নতুন সরকারের উদার নীতি ও প্রণোদনার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ঘুরে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এই প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের শক্তিশালী প্রবাহ রিজার্ভ পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ : গত বছর আগস্টে যেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০২৫ সালের জুনে তা কমে এসেছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি, একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমদানির বিধিনিষেধ শিথিল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক হ্রাস, এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামাতে কিছুটা সফল হয়েছি। তবে এটা ৩ শতাংশে না নামা পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট নই।’
ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দর ১২১ দশমিক ৩৫ থেকে ১২১ দশমিক ৯০ টাকার মধ্যে সীমিত।
গভর্নর জানান, আমরা বাজারকে রিল্যাক্স করেছিলাম, অনেকে আশঙ্কা করেছিল ডলার রেট ১৬০-১৭০ ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু সেটা হয়নি।
খেলাপি ঋণে স্বচ্ছতা : আ’লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জনসাধারণের কাছে গোপন ছিল। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩০ লাখ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশ।
ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ব্যাংক খাতের ভেতরের দুর্বলতা জনসমক্ষে তুলে ধরা শুরু করেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভুয়া জামানু, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ভুয়া ঋণ অনুমোদন এবং নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতাই এই পাহাড়সম ঋণের জন্য দায়ী।
গণঅভ্যুত্থানের পর আ’লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দেশের ব্যাংক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন করে গঠন করেছে।
দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও লুটপাটে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, রিজার্ভ রক্ষা ও আমদানি-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে নেওয়া সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল দিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে কোনো কোনো ব্যাংকে আমানু বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ, মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ সুশাসন ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতেই কাজ করছি। সামনে আরও সংস্কার অপেক্ষা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই অর্জন যদি ধরে রাখা যায়, তবে আগামী দিনের বাংলাদেশ একটি কার্যকর ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামো অর্জনে সফল হবে।’

্রিন্ট

আরও সংবদ