খুলনা | সোমবার | ১৮ অগাস্ট ২০২৫ | ৩ ভাদ্র ১৪৩২

ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিলেন খুলনার নাঈম শিকদার

পুলিশ ৫ মিটার দূর থেকে আমাকে গুলি করে, বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখে

খবর প্রতিবেদন |
০৪:০৭ পি.এম | ১৭ অগাস্ট ২০২৫


পুলিশ ৫ মিটার দূর থেকে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। আমার পিঠসহ সারা শরীরে প্রায় ৫০০ গুলি বিদ্ধ হয়। গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে মেয়রের বাসার সামনে। এ অবস্থায় আমি রাস্তায় পড়ে যাই। হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসা না দিয়ে ৫ ঘণ্টা রেখে দেয়।

আজ রোববার (১৭ আগস্ট) জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার আন্দোলনে আহত নাইম শিকদার শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এমন জবানবন্ধি দেন। নাইম শিকদারের বাড়ি বরগুনা জেলায়।

তিনি বলেন, আমি ২০২৪ সালে খুলনাস্থ হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম।

কোটার বৈষ্যমের কারণে মেধাবীরা চাকরি পায় না মর্মে আমরা জানতাম। ২০১৮ সালে আন্দোলনের ফলে কোটা প্রথা বাতিল হলেও ২০২৪ সালে আবার সেটি হাইকোর্টের একটি রায়ে পুনর্বহাল হয়। যার প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা চাকরি পাবে না, তবে কি রাজাকারের বাচ্চারা/নাতিপুতিরা পাবে?’। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই আন্দোলকারীদের দমানোর জন্য ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট’। এই সকল উসকানিমূলক বক্তব্যের পর ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। এরপর ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর দেশব্যাপী হামলা চালায়। আমি খুলনাতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি

৪ আগস্ট ২০২৪ সাল বিকাল ৩টার দিকে আমি আমার বন্ধু রাকিবসহ তিন শিক্ষার্থী খুলনা মহানগরীর শিববাড়ী মোড় এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সেখানে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ছাত্রজনতা জড়ো হয়েছে। ছাত্রজনতা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হয় এবং আরেক ভাগ নগর ভবন এলাকার দিকে রওনা হয়। আমাদের দল নগর ভবন এলাকায় পৌছানোর পর পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সেখানে খুলনার পুলিশ কমিশনার উপস্থিত ছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার মোজাম্মেলের নির্দেশে পুলিশ আমাদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে।

সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর আক্রমণ করে। আমরা চারদিক থেকে পুলিশকে ঘেরাও করলে পুলিশ আত্মসমর্পন করে এবং উক্ত স্থান ত্যাগ করে।

আমরা সেখানেই অবস্থান করি। পুলিশ বিকাল আনুমানিক ৬টার দিকে আমাদের ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমি রাস্তায় পড়ে যাই।

সহযোদ্ধারা আমাকে নিকটস্থ তিনটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনো হাসপাতাল আমাকে ভর্তি করেনি। কারণ তারা বলেছে, যে ভর্তি করা যাবে না, শেখ হাসিনার নির্দেশ। পরবর্তীতে আমাকে অটোরিকশায় করে খুলনা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। উক্ত হাসপাতালে আমাকে চিকিৎসা না দিয়ে ৫ ঘণ্টা রেখে দেয়। অতপর আমার অনুরোধে একজন ডাক্তার আমাকে অজ্ঞান না করে হাত দিয়ে পিঠ থেকে একটি বড় গুলি বের করে। (এ পর্যায়ে সাক্ষী তার পিঠের অসংখ্য গুলির ক্ষতচিহ্ন ট্রাইব্যুনালকে দেখায়)। এরপর ছাত্রলীগ এসে আমাদেরকে খুঁজতে থাকে। আমাকে একটি রুমে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে ১৯ তারিখ পর্যন্ত থাকি। পরে ১৯ থেকে ২৫ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত নেভি ক্যাম্প উপশম হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করি। গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত যশোর সিএমএইচে চিকিৎসা গ্রহণ করি। পরবর্তীতে আমাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। বর্তমানে আমি পিজি (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছি। সেখান থেকে আমি সাক্ষ্য দিতে এসেছি।

আমাদের ওপরে এই নির্বিচার গুলির জন্য দায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, খুলনার পুলিশ কমিশনার, উপ-পুলিশ কমিশনার, এসপি, ডিসি, ওসি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

আলজাজিরা, বিবিসিসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা কীভাবে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। গুলি করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানোর ভিডিও আমরা মোবাইলের মাধ্যমে দেখেছি। আমিসহ সকল আন্দোলনকারীর ওপর ভয়াবহ এই নির্যাতনের বিচার চাই।

তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।

্রিন্ট

আরও সংবদ