খুলনা | মঙ্গলবার | ১৯ অগাস্ট ২০২৫ | ৩ ভাদ্র ১৪৩২

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১২ জনের সাক্ষ্য

মারধরের পর তায়িমকে দৌড় দিতে বলে পুলিশ, দৌড়ালেই করে গুলি—ট্রাইব্যুনালে বড় ভাই রবিউল

খবর প্রতিবেদন |
১২:২২ এ.এম | ১৯ অগাস্ট ২০২৫


জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে চালানো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও তিনজন। তাঁরা হলেন শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি, শহীদ ইমাম হাসান তায়িমের ভাই রবিউল আউয়াল ও রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন।

সোমবার (১৯ আগস্ট) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ তাঁদের সাক্ষ্য নেন। এ নিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্য দিলেন ১২ জন।

শেখ হাসিনা ছাড়া এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। পরে ২০ আগস্ট-পরবর্তী সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য দিন ঠিক করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। আর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন। শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

শহীদ ইমাম হাসান তায়িমের ভাই রবিউল আউয়াল ভূঁইয়া তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর আমি সিলেটে এবং আমার ছোট ভাই ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ২০ জুলাই আমি আম্মুকে ফোন দিলে আম্মু জানান, বাড়িওয়ালা বলেছে, তায়িম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমার আম্মু কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে তায়িমের জুতা ও রক্ত দেখতে পান। সেখানে উপস্থিত লোকজন আমার মাকে জানায় যে, আপনার ছেলেকে ভ্যানে করে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানার দিকে নিয়ে গেছে।’

রবিউল আউয়াল আরও বলেন, ‘আমি তায়িমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে আমার খালাকে জানালে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখানে খোঁজাখুঁজির পর তায়িমকে না পেয়ে একজন সাংবাদিককে তায়িমের ছবি দেখালে তিনি বলেন, তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। পরের দিন আমার বাবা গিয়ে সেখান থেকে লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যান। বাবার কাছ থেকে জানতে পারি যে, আমার ছোট ভাইয়ের শরীরে ২০০-র মতো ছররা গুলি লেগেছিল।’

নিজের বাবা পুলিশে চাকরি করেন জানিয়ে রবিউল আরও বলেন, ‘তায়িমের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, পুলিশ টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তায়িম তার দুই বন্ধুসহ লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। পুলিশ সেখান থেকে তাদের তিনজনকে টেনে বের করে এবং বেধড়ক মারধর করে। পুলিশ তাদের গালি দিয়ে দৌড় দিতে বলে। তায়িম প্রথমে দৌড় দেয়। তখন তায়িমের পায়ে একজন পুলিশ সদস্য গুলি করে। সে পেছন ফিরে তাকালে তখন তার শরীরের নিম্নাংশে আরও একটি গুলি করা হয়। গুলিটি সামনের দিকে প্রবেশ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। তায়িমকে শটগান দিয়ে আরও অনেক গুলি করা হয়।’

রবিউল আরও বলেন, ‘তখন তার বন্ধু রাহাত তাকে পেছন দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তখন পুলিশ রাহাতকেও গুলি করে এবং তাকে বাধ্য করে তায়িমকে ফেলে রেখে যেতে। রাহাত চলে যাওয়ার পরও আধা ঘণ্টা পর্যন্ত তায়িম ওখানে পড়ে ছিল। তায়িম ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছিল এবং আকুতি করছিল ‘‘বাঁচান’’ ‘‘বাঁচান’’ বলে। সাংবাদিকসহ উপস্থিত অনেকেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাঁকে নিতে দেয়নি। বরং তারা তার মৃত্যুর দৃশ্য উপভোগ করছিল। অথচ ২০ গজের মধ্যে রাস্তার দুই পাশে দুটি হাসপাতাল ছিল।’

রবিউল বলেন, ‘আধা ঘণ্টা পরে তাকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ বুট জুতা দিয়ে মাড়িয়ে তার চেহারা বিকৃত করে ফেলে। তাদের মধ্যে ছিল এডিসি শামিম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ। পরে কেউ তাকে ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

রবিউলের অভিযোগ, যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন সাব-ইন্সপেক্টর সাজ্জাদুজ্জামান প্রথম পায়ে গুলি করেন। পরে এডিসি শামিম আরও একজনের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তায়িমের শরীরের নিম্নাংশে গুলি করেন। তারপর ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেন অনেকবার গুলি করেন। ঘটনাস্থলে তখন জয়েন কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, জয়েন কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি অপারেশন ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন।

রবিউল বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম, পুলিশ মামলা নেয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিবদের নির্দেশে আমার ভাইসহ আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আমি তাদের ফাঁসি চাই।’ পরে গুলিসংক্রান্ত ভিডিও দেখানো হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সূত্র : আজকের পত্রিকা 

্রিন্ট

আরও সংবদ