খুলনা | রবিবার | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৩০ ভাদ্র ১৪৩২

রক্ত-আগুনে থমকে গেছে নেপালের পর্যটন মৌসুম, অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৬ পি.এম | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫


রক্ত আর আগুনে থমকে গেছে নেপালের পর্যটন ও উৎসবের মৌসুম। সাধারণত হিমালয়ের দেশটিতে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত সময় থাকে শরৎকাল। এ মৌসুমে বিদেশি পর্যটকরা ভিড় করেন, আবার প্রবাসী নেপালিরা উৎসব পালন করতে দেশে ফেরেন। খুচরা বাজার, হোটেল, প্লেন, যানবাহন—সব ক্ষেত্রেই থাকে ব্যবসার উল্লম্ফন। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাঠমান্ডুর থামেল, দরবার স্কয়ার থেকে শুরু করে পোখারা, ভৈরহাওয়া ও চিতওয়ানের মতো জনপ্রিয় পর্যটন এলাকায় নীরবতা নেমে এসেছে। চারপাশে পোড়া হোটেল, দগ্ধ যানবাহন—এ যেন অচেনা এক নেপাল!

সাম্প্রতিক জেন জি-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সহিংসতায় দেশজুড়ে পর্যটকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ভারতীয় পর্যটকরা, যাদের কাইলাশ মানস সরোবর সফরের জন্য ব্যাপক বুকিং ছিল, তারা সফর বাতিল করেছেন।

অর্থনীতিবিদদের হিসাবে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো, নথিপত্র ও ব্যবসায়িক খাত মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ কোটি রুপির ক্ষতি হয়েছে, যা দেশটির দেড় বছরের বাজেট বা জিডিপির প্রায় অর্ধেক।

অর্থনীতিবিদ চন্দ্র মণি আধিকারী জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে নেপালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এক শতাংশেরও নিচে নেমে আসতে পারে। এরই মধ্যে ভাট-ভাটেনি সুপারমার্কেট, চৌধুরী গ্রুপ, এনসেলসহ শীর্ষ করদাতাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কর্মসংস্থান সংকট
এই আন্দোলন চলাকালে প্রায় এক রাতেই চাকরি হারিয়েছেন কমপক্ষে ১০ হাজার নেপালি। হোটেল অ্যাসোসিয়েশন নেপালের হিসাবে, হোটেল খাতে ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি রুপি।

গাড়ি বিক্রেতাদের ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি রুপিতে। ভাট-ভাটেনি সুপারমার্কেটের ২৮টি শাখার মধ্যে ২১টি আক্রান্ত হয়েছে, যার কয়েকটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

বিমা খাতেও চাপ বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু ভাট-ভাটেনির ক্ষয়ক্ষতির বিমা দাবিই হতে পারে ২৫০ কোটি রুপির বেশি।

ঘুরে দাঁড়ানোর আশা
তবে ব্যবসায়ী মহলে আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। পর্যটন উদ্যোক্তা যোগেন্দ্র শাক্যা বলেছেন, দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি পুরেনো অভ্যাসে ফেরে, তাহলে আগামী ছয় মাসে আস্থার সংকট গভীর হতে পারে।

শুক্রবার নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার পর থেকে সহিংসতা কমেছে, কারফিউ উঠতে শুরু করেছে। খুচরা ব্যবসায়ী, গাড়ি আমদানিকারক ও পরিবহন উদ্যোক্তারা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করছেন।

তবে শিল্পপতিদের মতে, বড় করপোরেট হাউস ও বেসরকারি সম্পত্তি আক্রমণের কারণে উদ্যোক্তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। নেপাল শিল্পীদের কনফেডারেশনের সভাপতি বিরেন্দ্র রাজ পাণ্ডে বলেছেন, আমরা ভেঙে পড়েছি, কিন্তু এগিয়ে যেতে হবে। অনেক উদ্যোক্তাই ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছেন।

হোটেল, টেলিকম, অটোমোবাইল থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এনসেল ঘোষণা করেছে, আমরা আবার গড়ে তুলবো, জনগণ ও দেশের জন্য কাজ করবো।

ভাট-ভাটেনি জানিয়েছে, ‘ধ্বংস যতই হোক, আমাদের শক্তি তার চেয়ে বড়।’ চৌধুরী গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক নিরবাণ চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়াবো, ইতিহাস আগুন নয়, আমাদের অদম্য প্রত্যয়কেই মনে রাখবে।’

পর্যটন খাতের সংগঠন নেপাল অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্টস (নাটা) জানিয়েছে, দেশ এখন স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে এবং পর্যটনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে উঠছে। তারা নতুন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে দেশে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ নেপালের সব বিমানবন্দর ও পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে চলছে।

তবে পোখারা, ভৈরহাওয়া, ঝাপা, মোরাং-বিরাটনগর, ধানগড়ি, মহোত্তরী, দাং-তুলসিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত দুই ডজন হোটেল বড় ক্ষতির শিকার হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮০০ কোটি রুপির বেশি। এতে দুই হাজারেরও বেশি কর্মীর জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে, আর হোটেলগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় মেটাতেও সমস্যায় পড়বে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভূমিকম্প, লোডশেডিং, ধর্মঘট, কোভিড—সবকিছুর চেয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতাই নেপালের অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দুর্নীতি আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি নেপালের জন্য বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবুও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা আশাবাদী- ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েই নতুন ভবিষ্যৎ গড়বে নেপাল।
সূত্র: কাঠমান্ডু পোস্ট

্রিন্ট

আরও সংবদ