খুলনা | মঙ্গলবার | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৩১ ভাদ্র ১৪৩২

থানা থেকে হাসপাতাল লাশ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কর্তৃপক্ষ নেয়নি ব্যবস্থা

লাশ আটকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ খুমেক হাসপাতালে ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলীর বিরুদ্ধে

বশির হোসেন |
১২:৪৫ এ.এম | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫


মাথায় আঘাত পেয়ে খুলনার কয়রার ইজিবাইক চালক রাজ্জাক গাজী ভর্তি ছিলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ কেস হওয়ায় লাশটির ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালটির মর্গে। কিন্তু সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে লাশটি ছেড়ে দেন ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলী। গত সপ্তাহে পারভীন নামে একজন কলেজছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় বাসা থেকে। তাকেও পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত ছাড়া ছেড়ে দেন এই প্রভাবশালী ওয়ার্ড মাস্টার। এসব মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনায় পরিবার যখন স্বজন হারানোর শোকে পাথর, তখন সেই দুঃসহ মুহূর্তকে নোংরা বাণিজ্যে পরিণত করছে হাসপাতালের এক সাধারণ ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলী।
জিম্মি হয়ে ওয়ার্ড মাস্টারকে ৩ হাজার টাকা দেয়া মৃত রাজ্জাক গাজীর বোনের ছেলে ইব্রাহিম গাজী খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। ইব্রাহিম গাজী সময়ের খবরকে বলেন আমার মামা রাজ্জাক গাজী গাছের সাথে আঘাত পেয়ে কয়েক দিন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর রোববার মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলে ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলী আমার কাছে ৫ হাজার টাকা চায়। কিন্তু আমি অনেক কষ্টে তাকে তিন হাজার টাকা দিয়ে রাজি করিয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনাসহ আশেপাশের জেলাগুলোর মধ্যে ময়না তদন্ত হয় শুধুমাত্র খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যে কারণে খুলনাসহ আশেপাশের জেলা থেকে অস্বাভাবিক মৃত্যু, আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা ও আকস্মিক মৃত্যুর লাশগুলো এই হাসপাতালেই ময়না তদন্ত করা হয়। এসব মৃত মানুষের পরিবারের শোক ও আবেগ কাজে লাগিয়ে নিজেই লাশ ময়নাতদন্ত না করে ছেড়ে দেয়ার তদবির করেন আনসার আলী। কালবেলার কাছে আসা একাধিক মোবাইল কল রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে লাশের সজনদের জিম্মি  করে কিভাবে  টাকা নেন তিনি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৩০টি লাশ ময়নাতন্ত না করে লাশ প্রতি ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। মর্গে আসা আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা আকস্মিক মৃত্যুর লাশ হস্তান্তর করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। ভুক্তভোগীদের দাবি, আনসার আলীর চক্র ৫ হাজার টাকা না নিলে মৃতদেহ দেয় না। এভাবে লাশের ওপর চলছে নির্লজ্জ ব্যবসা।
অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে নারায়ণগঞ্জ থেকে খুমেক হাসপাতালে বদলি হয়ে  আসার পেছনেও ছিল আনসার আলীর প্রভাব ও তদবির। চলতি বছরের ১ আগস্ট খুলনায় যোগদানের পর থেকেই তিনি লাশ ব্যবসায় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
খুমেক হাসপাতালের মর্গে মরদেহ আটকে রেখে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানকালে এর সত্যতা মিলেছিল। যার কারণে ওই সময়ে ওয়ার্ড মাস্টারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পরিচালক ডাঃ এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। এমনকি তৎকালীন এক ওয়ার্ড মাস্টার মোহাম্মদ আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে ছিলো একই অভিযোগ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কিছু লাশের ক্ষেত্রে যেমন নিজ ঘরে আগুনে পোড়া, ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া ও পানিতে ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের সকল সদস্যের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত না করে ছেড়ে দিতে পারেন একমাত্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সেক্ষেত্রে নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। তবে জেলা প্রশাসকের অনাপত্তির ধারধারেন না ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলী। নিজেই তৈরি করেছেন লাশ নিয়ে বাণিজ্য চক্র।
সোনাডাঙ্গা থানার সদ্য বিদায়ী অফিসার ইনচার্জ মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, থানা থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলীর লাশ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। প্রতিকার না পেয়ে হাসপাতাল পরিচালককে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি এই লাশ বাণিজ্যের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। কোন প্রতিকার পাইনি। অদৃশ্য কারণে সব সময় তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছেন।
হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, আন্তবিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ জনের মতো রোগী ভর্তি থাকেন। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ জনের মতো রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া, আত্মহত্যা করা, আগুনে পোড়া, পানিতে ডুবে যাওয়া মরদেহ সরাসরি রোগীর স্বজনের কাছে হস্তান্তর করে তা মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে রোগীর স্বজনরা হয়তো পোস্টমর্টেমের পরে বা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র এনে মরদেহ নিয়ে যান।
অভিযুক্ত ওয়ার্ড মাস্টার আনসার আলীর সাথে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় হাসাপাতালের উপ-পরিচালকের কক্ষে। সেখানে তিনি সময়ের খবরকে বলেন আমি সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছি। আমার বিরুদ্ধে সবই অপপ্রচার । এর একটিরও কোন প্রমান নেই যে কোন লাশ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ সুজাত আহমেদ সময়ের খবরকে বলেন, আমি একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। পরিচালক আসলে আমি এই বিষয়ে স্যারকে বলবো। তদন্ত করে দেখবো যদি লাশ বাণিজ্যের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ