খুলনা | বুধবার | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১ আশ্বিন ১৪৩২

বদলি বানিজ্যি, পদায়ন ও তদন্তের নামে অর্থ আদায়

মোংলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ

মোংলা প্রতিনিধি |
১১:২৯ পি.এম | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫


মোংলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মোংলায় যোগদানের পর থেকেই গত দুই বছর ধরে উপজেলা চত্বরে অফিস না করে কৌশলে মোংলা পোর্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় তলার ছাত্র/ছাত্রীদের ক্লাসরুম দখল করে তিনি অফিস বানিয়েছেন। এখানে বসেই করছেন বদলী বানিজ্যিসহ নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। অফিসে আসেন ইচ্ছে-খুশি মতো, কখনও বেলা ১১টার পর আবার কখনও আসেনই না। আবার অফিসে এলেও কয়েকজন নিজস্ব শিক্ষক নিয়ে খোশ গল্পে মেতে থাকতেন তিনি। তবে সঠিক সময় অফিসে আসা এবং নিয়ম মেনে অফিস করা হচ্ছে বলে দাবি শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশের। শুধু এই অনিয়মই নয়, বদলি, পদায়ন ও তদন্তের নামে নানা কায়দায় শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এছাড়া রয়েছে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ।
ভুক্তভোগী শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাগেরহাটের একজন সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশ। সে সুযোগে কয়েকজন শিক্ষক, দুই জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারীকে নিয়ে মোংলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে একটি সিন্ডিকেট গড়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে তিনি। তার এ অনিয়ম-দুর্নীতি আর অর্থ আদায়ের বিষয়টি শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রকাশ পেলে সমালোচনার ঝড় উঠে। তিনি সরাসরি এসকল অর্থ আদায়ের সাথে না জড়িয়ে অফিস সহকারী এমরান হোসেন, দুই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা পুস্পজিৎ মন্ডল ও গুরুদাশ বিশ্বাসকে দিয়ে বেশীরভাগ সময় এ অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছেন। তাদের এমন ঘটনা নিয়ে দুই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে জড়িয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয় অভিভাবকসহ ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। বেশ কয়েকবার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তদন্তও করেছেন তাদের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রথমে পুস্পজিৎ মন্ডল, পরে গুরুদাশ বিশ্বাসকে জরুরি ভিক্তিতে মোংলা উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে অন্যাত্র বদলী করা হয়। কিন্ত বড় দুর্নীতিবাজ শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
গত বছরের ৫ আগস্ট বহু আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলেও আ’লীগের পৃষ্ঠপোষক শিক্ষা কর্মকর্তার পিন্টু রঞ্জন দাশের অনিয়ম-দুর্নীতি আর অর্থ আদায়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। অবৈধ উপার্জনে তার এলাকায় নিজে তৈরী করেছে পাকা বাড়ি এবং দামী গাড়ির মালিকও হয়েছেন এ শিক্ষা কর্মকর্তা। দুর্নীতিবাজ দুই সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা বদলী হলেও দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই তার দপ্তরের প্রধান অফিস সহকারী এমরান হোসেন। শিক্ষা কর্মকর্তার এ অপকর্মের সহায়তা করছে কয়েকজন শিক্ষক ও বর্তমান শিক্ষক সমিতির নামধারী সভাপতি মোঃ ফারুক হোসেন/সাধারণ সাইদুর রহমান। 
পিন্টু রঞ্জন দাস মোংলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পদে মোংলায় যোগদান করেণ ২০২৩ সালে সালের ১০ ডিসেম্বর। উপজেলার একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন তিনি যোগদানের পর থেকেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষকদের বদলি, সংযুক্তি, প্রতিস্থাপন  ও  ‘বদলী বাণিজ্য’ শুরু করেন। উপজেলা শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বিদ্যালয়ের দূরত্ব ও অবস্থান অনুযায়ী বদলিতে শিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি ৩০ হাজার থেকেত ৫০ টাকা করে ঘুষ নেন। 
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে ২০২২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশে শিক্ষকদের ডেপুটেশন (সংযুক্তি) আদেশ বাতিল করলেও পিন্টু দাশ ওই আদেশের তোয়াক্কা না করে নিজেই এক অফিস আদেশে টাকা খেয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ডেপুটেশনের নামে এক স্কুল থেকে পছন্দের স্কুলে বদলী করছেন। তার এ অনিয়মের ব্যাপারে কোন শিক্ষক প্রতিবাদ করলে অফিসে ডেকে এনে ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি তুলে ধরে বদলী বাতিল হওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।  
মোংলা সাহেবের মেঠ আদার্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোল­া শফিকুল ইসলাম বলেন, তার স্কুলে নুরুন্নাহার নামের এক শিক্ষিকা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কিন্ত মোল­া শফিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে গেলে শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জনের পরামর্শে তাকে যোগদান করতে দেয়া হয়নি। পরে মোটা অংকের টাকার বিনিময় সেখানে যোগদান করতে হয়েছে। আরো টাকার জন্য এখনও শিক্ষা কর্মকর্তার চাপের মধ্যে রয়েছেন প্রধান শিক্ষক মোল­া শফিক। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, বেকায়দায় ফেলে টাকা আদায় করা শিক্ষা কর্মকর্তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। টাকা দিলেই সব দোষ নির্দোষ হয়ে যায়, আর না দিলে সেই শিক্ষককে এমন স্কুলে বদলী করে সেখান থেকে আসা-যাওয়াই দিন পার হয়ে যায়, দৈনিক খরচ হয়ে যায় ৪/৫শ’ টাকা। বর্তমানে অনলাইনে বদলীর অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ২০/২৫ শিক্ষক-শিক্ষিকা। তার এ অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।   
পোর্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণ সংঙ্কর বাওয়ালী বলেন আমার স্কুল পৌর শহরের মধ্যে। সেখানে অনেক ছাত্র/ছাত্রী সামাল দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তা ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয়তলার পুরোটাই দখলে নিয়ে অফিসিয়াল কার্যক্রম চালাচ্ছে। উপজেলা পরিষদের নতুন ভবন তৈরী হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদার সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস স্থানান্তর করার জন্য তাগিদ দিলেও কৌশলে সেখানে না এসে ক্লাসরুম দখল করে তার দুর্নীতি আর অর্থ আদায়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শিক্ষক মোঃ ফারুক নিজেকে শিক্ষক সমিতির সমিতির সভাপতি দাবি করে বলেন শিক্ষকদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে যেতে হয়। অনেকে বিষয়টি নিয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে অপবাদ ছড়াচ্ছে। 
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পিন্টু রঞ্জন দাশ’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে শিক্ষক নেতা ও শিক্ষকদের মধ্যে গ্র“পিং রয়েছে। এরা আমার বিরুদ্ধে অহেতুক কথা ছড়াচ্ছে। আর অনলাইন বদলিতে আবেদন করতে হয় অনলাইনে, সফটওয়ারের মাধ্যমে সব কাজ করা হয়, এখানে টাকা লেনদেনের ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা নাসরিন আক্তার বলেন, অভিযোগ এখনও হাতে পৌঁছায়নি, তবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের হয়রানি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

্রিন্ট

আরও সংবদ