খুলনা | সোমবার | ১৩ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নামসর্বস্ব সংস্থাগুলো বাদ দিন

|
১১:৫৫ পি.এম | ০৩ অক্টোবর ২০২৫


বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন আজ শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অন্যতম শর্তও। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) স¤প্রতি ৭৩টি সংস্থার একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে, যারা আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু অনুসন্ধানে যা উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক ও হতাশাজনক।
তালিকার অনেক সংস্থা কার্যত অকার্যকর। যেমন কুড়িগ্রামের ‘অগ্রযাত্রা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ বর্তমানে কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করছে না। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন, একসময় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করলেও এখন প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ক্রিয়। উপরন্তু ভিজিডি কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও চলছে তাদের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলো মামলায় অভিযুক্ত, কর্মীবিহীন, কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি সংস্থাকে কীভাবে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হলো? তালিকায় স্থান পাওয়া অনেক সংস্থার ঠিকানা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কোথাও সংস্থাটির প্রধানের ব্যক্তিগত বাসভবনকে অফিস দেখানো হয়েছে, কোথাও নির্মাণাধীন ভবনকে কার্যালয় বলা হয়েছে। কোনো সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মী বলতে বাবা-ছেলে দু’জন ছাড়া কেউ নেই। কোথাও আবার পরিত্যক্ত ঘরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। এর থেকে স্পষ্ট, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের নামে নামসর্বস্ব সংগঠনের প্রসার ঘটছে, যাদের এই কাজে প্রকৃত সক্ষমতা নেই।
সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরও দুশ্চিন্তা তৈরি করে। নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, যে সংস্থার নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদের কেউ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমোদন পাবে না। অথচ প্রাথমিক তালিকায় এমন বেশ কিছু সংস্থা রয়েছে, যাদের নেতারা অতীত বা বর্তমানে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ অবস্থায় নিরপেক্ষতা কি আদৌ সম্ভব? নির্বাচন পর্যবেক্ষণ যদি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতপূর্ণ হয়, তবে তা জনগণকে বিভ্রান্ত করবে এবং ভোটের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার অভাবও বড় একটি সমস্যা। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কোনো সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী, গবেষণার দক্ষতা, মাঠপর্যায়ে সংগঠিত কাঠামো ও আর্থিক স্বচ্ছতা অপরিহার্য। অথচ তালিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে ৫০ জনের বেশি কর্মী আছে মাত্র ছয়টিতে। অনেক সংস্থা আগে কখনো এককভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি। এর ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন আসার বদলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
এখানে ইসির ভূমিকা সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে। ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব স্বীকার করেছেন যে যাচাই-বাছাই খুব পদ্ধতিগতভাবে করা হয়নি। তাহলে কি এ ধরনের গুরুতর কাজে অবহেলা করা হয়েছে? যদি তা-ই হয়, তবে এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  অতীতে আমরা দেখেছি, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও নামসর্বস্ব সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তখনো ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে কেন আবার একই ভুল করা হচ্ছে? যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের নামে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠে নামে, তবে তাদের প্রতিবেদনের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরাও আস্থা রাখতে পারবে না। 
নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্ব›িদ্বতার বিষয় নয়; এটি জনগণের আস্থা অর্জনেরও প্রশ্ন। নামসর্বস্ব সংস্থাকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে আস্থা অর্জন করা অসম্ভব। ইসিকে তাই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
জরুরি হলো প্রকৃতপক্ষে সক্রিয়, অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া। স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে যেসব সংস্থা দীর্ঘদিন মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রশ্নে কাজ করছে, সেসব সংস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, আর্থিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে।
 

্রিন্ট

আরও সংবদ