খুলনা | মঙ্গলবার | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

একই প্রতিষ্ঠানে ১৮ বছর, প্রভাব খাটাচ্ছেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা অতিরিক্ত পরিচালক ‘আওয়ামী স্টাইলে’ নিয়ন্ত্রণ

অনিয়ম-দুর্নীতির ‘স্বর্গরাজ্য’ বিটাক

এন আই রকি |
০১:০৬ এ.এম | ০৫ অক্টোবর ২০২৫


বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) খুলনা কার্যালয়টি চলছে এক ‘হ য ব র ল’ অবস্থায়। গত ৫ আগস্টের পর সরকারি সব দপ্তরে দৃশ্যমান পরিবর্তন এলেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি বিটাকে। প্রায় ১৮ বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছেন খুলনা বিটাকের বর্তমান অতিরিক্ত পরিচালক (এডি) ও গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা এম মোর্শেদ আলম। তাঁর সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তিনি এখনো ‘আওয়ামী স্টাইলে’ নিয়ন্ত্রণ করেন খুলনা বিটাক। এমনকি, বিটাকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মচারী সরবরাহও এখনো এক শ্রেণির প্রভাবশালীর হাতে নিয়ন্ত্রিত।
অনুসন্ধানে খুলনা বিটাকের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। অতিরিক্ত পরিচালক মোর্শেদ আলমের আপন মামাতো ভাই আবিদকে দিয়ে ‘নারীদের মোবাইল সার্ভিসিং’ নামে একটি ট্রেড পরিচালনা করা হচ্ছে, যেখানে মামাতো ভাইয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার জামিলের প্রভাবও অনেক বেশি। ড্রাইভার জামিলের শালাকে দিয়েই বিটাকের অভ্যন্তরে একটি ক্যান্টিন পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ড্রাইভার জামিল শিক্ষার্থীদের কাছে অনৈতিকভাবে ওয়াইফাইয়ের ব্যবসা করছেন এবং এর বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। এমনকি, এমএলএসএস (গখঝঝ) পদে জান্নাতি নামে এক মহিলা কাজ করছেন, যেখানে ফিরোজা বেগমের নিয়োগ রয়েছে। বিষয়টি বিটাকের প্রশাসনিক কর্মকর্তাও জানেন।
আরো জানা যায়, সরকারি অনুমতি ছাড়া বিটাকে গাছ কাটা, বিভিন্ন গাছের টুকরা টেন্ডার ছাড়া বিতরণ, সিকিউরিটি গার্ড আলমগীরকে দিয়ে স্টুডেন্ট ভর্তির বিষয়ে সুপারিশ, নারী হোস্টেলে ছেলে-মেয়ে একত্রে নাচ-গান করা, প্রত্যেক ব্যাচে আবাসিক ছেলে ও মেয়েদের পোশাকের টেন্ডার নিয়ে ধুম্রজাল, কর্মচারীকে মানসিক টর্চারসহ নানান অপকর্মের পেছনে রয়েছেন অতিরিক্ত পরিচালক।
শুধু তাই নয়, সিবিএ নেতাদের প্রভাবও অনেক এই প্রতিষ্ঠানে। সিবিএ-র কোষাধ্যক্ষ মাসুমা খাতুন অতিরিক্ত পরিচালকের খুবই আস্থাভাজন। তিনি মূলত ড্রাফটসম্যান হলেও প্রশাসন বিভাগে কাজ করেন। সিবিএ সভাপতি মোঃ আব্দুল­াহ এবং বিটাকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান শিকদারের সাথে খুবই ভালো সখ্যতা। 
তাঁরা দুইজন এই প্রতিবেদককে জানান, সরকারি অনুমতি ছাড়া কোনো গাছ কাটা হয়নি, তবে ঝড়ের কারণে কিছু গাছের ডাল কাটা হয়েছিল। তাঁরা আরো জানান, গাছের কিছু গুঁড়ি ও কাটা অংশ মাস্টার রোলের একজন বয়স্ক কর্মচারীকে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়েছে। এমনকি ক্যান্টিনের বিষয়ে তাঁরা সাফাই দিয়ে বলেন, আশেপাশে কোথাও কোনো দোকান না থাকায় এটা  বসানো হয়েছে।
জানা যায়, অতিরিক্ত পরিচালক এম মোর্শেদ আলম গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী এলাকার সন্তান। ২০০৩ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি তিনি বিটাকে চাকরিতে যোগদান করেন। খুলনা বিটাকে বদলি হন ২০০৭ সালে। গত ১৮ বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই রয়েছেন। তিনি খুলনায় আসার পর বেশ কয়েকটি পদোন্নতি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁর সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার শিলার সখ্যতা ছিল। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা সেনহাটি গ্রামে শিলার বাড়ির পাশেই এম মোর্শেদ আলমের বাড়িসহ অনেক জমি রয়েছে। তিনি শিলাদের কাছে কিছু জমি কয়েক বছর আগে বিক্রিও করেছিলেন। তাঁর সন্তান রুয়েটে লেখাপড়া করে। তাই তিনি বগুড়া বিটাকে বদলির জন্য উঠে পড়ে তদবির শুরু করেছেন। গত সপ্তাহে খুলনার বিটাকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মহাপরিচালকের নিকট এম মোর্শেদ আলমের সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন।
বিটাকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান শিকদারকে বলেন, ফিরোজা বেগম অসুস্থ থাকার কারণে জান্নাতি তাঁকে নিয়ে আসে এবং দিয়ে যায়। সে কাজ করে না বলে তিনি দাবি করেন।
বিটাকের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ওয়াহিদুল হক রাসেলকে জানান, আবাসিকে শিক্ষার্থীদের জামা-কাপড় ইজিপিতে টেন্ডারের মাধ্যমে দেওয়ার কথা রয়েছে। তাঁর আসলে জানা নেই এতদিন কিভাবে দিয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে আছেন। 
নারী হোস্টেলে একত্রে নাচানাচির বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে ঊর্ধ্বতন স্যাররা উপস্থিত ছিলেন। সিকিউরিটি গার্ড আলমগীরের সাথে শিক্ষার্থীদের সখ্যতার বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। মাসুমা খাতুনকে প্রয়োজনে প্রশাসনে কাজে লাগানো হয়েছে বলেও তিনি উলে­খ করেন।
খুলনা বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক (কেন্দ্র প্রধান) এম মোর্শেদ আলমকে বলেন, তাঁর আত্মীয় আবিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ রয়েছে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাঁকে নেওয়া হয়েছে। ড্রাইভারকে দিয়ে ক্যান্টিন চালানোর বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ওয়াইফাইয়ের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা সত্য নয় বলে তিনি জানান। এছাড়া মুঠোফোনে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের মহাপরিচালক পরিমল সিংহকে জানান, খুলনা বিটাকের অভিযোগগুলোর বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন।

্রিন্ট

আরও সংবদ