খুলনা | সোমবার | ১৩ অক্টোবর ২০২৫ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়

|
১২:১০ এ.এম | ১৩ অক্টোবর ২০২৫


শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর মানুষ ভেবেছিল একটি নতুন সূচনা হবে, যেখানে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু পদক্ষেপ সেই আশা পূরণ করছে না বরং অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো ধারাবাহিকতাই যেন অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) সা¤প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দমনমূলক সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে সরকারের সমালোচক ও আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হচ্ছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যেখানে বিচারহীনতার অবসান ঘটবে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পরিবর্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাজারো মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন, যাঁদের অনেকেই কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করা হয়েছে। এমনকি পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না।
অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তি দেখাচ্ছে যে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত নির্যাতনের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাস্তবে আইনটি পরিণত হচ্ছে এক রাজনৈতিক অস্ত্রে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে কোনো সভা, প্রকাশনা বা অনলাইন পোস্ট পর্যন্ত ‘নিষিদ্ধ দলের সমর্থন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে-এমনকি যাঁরা কেবল সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করছেন, তাঁরাও গ্রেফতারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুর বক্তব্যটি এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের যে স্বেচ্ছাচারিতা মানুষ সহ্য করেছে, অন্তর্বর্তী সরকারেরও তা অনুকরণ করা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, সরকার একই পুরোনো নীতির পুনরাবৃত্তি করছে-শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, পদ্ধতি নয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা আশঙ্কা করছেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রভাব ফেলবে। সম্পাদক পরিষদ ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে যে এই আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে। আর গণমাধ্যম যখন ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের জবাবদিহি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।অন্যদিকে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক সমর্থকদের যেখানে সন্দেহবশতঃ গ্রেফতার করা হচ্ছে, সেখানে মব সহিংসতা বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে মনে হতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার বাছাই করে আইন প্রয়োগ করছে, যা রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে মানুষ সমানভাবে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার ভিন্নমত দমনের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সরকার যে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিল, তা এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যদি সত্যিই মানবাধিকার রক্ষা করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেফতার বন্ধ করা, মিথ্যা মামলায় আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া এবং আইনের প্রয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনার পতনের পর জনগণ যে মুক্তির আশা করেছিল, সেই আশা এখনো পূরণ হয়নি। সন্ত্রাসবিরোধী আইন যেন কোনোভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন অস্ত্রে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এখনই এ বিষয়গুলো উপলব্ধি এবং নিবর্তনমূলক আইনগুলো সংশোধন করা উচিত।
 

্রিন্ট

আরও সংবদ