খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৫ | ৮ কার্তিক ১৪৩২

বেনাপোলে ধরা পড়লো মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা কোটি টাকার মালামাল

বেনাপোল প্রতিনিধি |
০৬:০১ পি.এম | ২৩ অক্টোবর ২০২৫


দীর্ঘ ২৫ দিন ধরে বেনাপোল স্থলবন্দরে আটক থাকা ভারতীয় তিনটি ট্রাকে অবশেষে ধরা পড়েছে ঘোষণাবহির্ভূত কোটি টাকার ব্লেড কারসাজি।

বুধবার (২২ অক্টোবর) দিনব্যাপী বন্দরের ৪২ নম্বর শেডে পণ্য আনলোড ও পরীক্ষণের সময় মিলেছে ১০ লাখ ৮০ হাজার পিস ব্লেড, সঙ্গে সাত প্যাকেজ বডি স্প্রে, কাজল, পারফিউম তেল, জেল পেনসহ বিভিন্ন অঘোষিত পণ্য। এতে সরকারের কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। একদল কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পরীক্ষণের নেতৃত্ব দেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার সাকিব রায়হান।

এদিকে বেশ কিছুদিন যাবত বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সংবাদকর্মীদের কোন তথ্যই দিচ্ছেন না। কত টাকার মালামাল আটক হচ্ছে। কত টাকা শুল্ক ফাঁকি হচ্ছে এসব কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সবাই মুখে কুলুপ এটেছেন। বাধ্য হয়ে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য নিতে হচ্ছে।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ‘আশিকুল ইসলাম অ্যান্ড সন্স’ নামে এক আমদানিকারক ভারত থেকে ৩০ হাজার ৮৩৮ কেজি ওজনের ‘স্টিল আইটেম অ্যান্ড আদার্স’ ঘোষণায় তিনটি ট্রাকে পণ্য আনেন। ম্যানিফেস্ট নং: ৬০১/২০২৫/০০৩/০০৬১২৪৭/০৯ এবং ট্রাক নম্বর: ডব্লিউবি ০৩সি-৫৯২১, ডব্লিউবি ৩৩ডি-১০২৭ ও ডব্লিউবি ১১সি-৩১৩৩।

একই দিনে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে জানায় এ চালানে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনা হয়েছে। এরপর বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্যবাহী ট্রাকগুলো আটক করে এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের নবনির্মিত কার্গো ভেহিকেল টার্মিনালে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তা প্রদান করে। তবে রহস্যজনকভাবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ট্রাক তিনটির পরীক্ষণ করতে ২৫ দিন দেরি করেন। এই সময়ের মধ্যে ডকুমেন্ট জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হলে বুধবার (২২ অক্টোবর) অবশেষে পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হয়।

বেনাপোল বন্দরের ৪২ নম্বর শেড ইনচার্জ আমিনুর রহমান জানান, তাদের রেকর্ড অনুযায়ী ট্রাকগুলো ঘোষণাপত্রে ‘স্টিল আইটেম অ্যান্ড আদার্স’ হিসেবে উল্লেখ ছিল।

কিন্তু স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মূল ডকুমেন্টটি পরবর্তীতে পরিবর্তন করে নতুন (জাল ডকুমেন্ট) ইনভয়েজে ৯ লাখ ব্লেড দেখানো হয়। সেখানে আবার বাস্তবে পাওয়া গেছে তারও বেশি-১০ লাখ ৮০ হাজার পিস। কাস্টমসের দীর্ঘ সূত্রিতার কারনে অনিয়ম করতে সুযোগ পায় এ আমদানিকারক ব্যবসায়ী।

বন্দরের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এনএসআইয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্যে এমন জালিয়াতি ধরা পড়লেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ২৫ দিনের দীর্ঘ নীরবতা ও বিলম্বে পরীক্ষণ নিয়ে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে।

স্থানীয় সাধারন ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান জানান, এখানে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ২৫ দিন ধরে আমদানিকারককে সময় দিয়েছেন পুরোনো নথি গায়েব করে নতুন নথি তৈরির জন্য।

তিনি আরো বলেন, বেনাপোলের এই ঘটনা কেবল একটি চালানে নয়-এটি কাস্টমস প্রশাসনের ভেতরকার অসাধু কিছু কর্মকর্তার বহুদিনের অনিয়ম, দুর্বলতা ও দায়হীনতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি, যা সরকারের রাজস্ব নিরাপত্তার জন্য বড় সতর্ক সংকেত।

বেনাপোল স্থলবন্দরে এনএসআইয়ের সক্রিয় ভূমিকা ও তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বড় অভিযান পরিচালিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকার শত কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।

বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) শামীম হোসেন রেজা জানান, জব্দ করা ভারতীয় পণ্য বোঝায় অবৈধ চালানটি কাস্টমস বন্দরের হেফাজতে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। তারা চাইলে ট্রাকটি খুলে দেখতে সহযোগীতা করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টির সর্বশেষ জানতে বেনাপোল কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার সাকিব রায়হানকে ফোন দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে বেনাপোল কাস্টম হাউসের একটি সূত্র জানায়, আমদানিকৃত পণ্যসমূহ জব্দ করা হয়েছে এবং এ ঘটনায় প্রয়োাজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেনাপোল বন্দরে প্রথম থেকেই নানান অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী বেনাপোল বন্দর থেকে শুল্কফাঁকি দিয়ে আমদানি পণ্য পাচার আরও বাড়িয়েছে। এসব দুর্নীতিবাজরা সন্ত্রাসী প্রকৃতির।

গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে বন্দর এলাকা থেকে কাগজপত্র ছাড়া একটি ভারতীয় ট্রাকের পণ্য গোপনে আরেকটি বাংলাদেশি ট্রাকে লোড করা হয়। পরে বেনাপোল বন্দরের বাইপাস সড়কের ওপর থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিজিবি আটক করে। ট্রাকটি বেনাপোল বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে তল্লাশি করে ১ হাজার ৪৭৬ পিস শাড়ি, ২১৫ পিস থ্রি-পিস, মোটরসাইকেলের দুটি টায়ার, ১০ হাজার ৬৯৩ পিস ওষুধ, ৭৪ হাজার ৪৫৫ পিস কসমেটিক্স ক্রিম জব্দ করা হয়। এসব পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ টাকা। এছাড়া গত ২৩ সেপ্টেম্বরে কাগজপত্র ছাড়া এক ভারতীয় পণ্য বোঝাই ট্রাক আটক হয়। তার কোন মালিকানা পাওয়া যায়নি। ট্রাক রেখে ভারতীয় চালক পালিয়ে যায়। তাছাড়া বন্দর এলাকায় বিজিবি কর্তৃক প্রতিনিয়ত চোরাচালান পণ্য জব্দ হচ্ছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ