খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০৩ এপ্রিল ২০২৫ | ১৯ চৈত্র ১৪৩১

অদ্ভূত এক রোগের নাম রাগ! জেনে নিন রাগ সৃষ্টির কারণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০১:০৫ এ.এম | ২০ জুন ২০২১

কেস স্ট্যাডি-১, রহিম (ছদ্ম নাম) সাহেব, বয়স-৫৫ বছর। অফিসের একজন বস। উক্ত অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারিবৃন্দ তার কক্ষে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মোটেই প্রবেশ করেন না। কারণ বস খুব রাগী এবং তার আচরণ বেশির ভাগ সময়ে আক্রমণাত্মক। তিনি কারণে-অকারণে তার অধীনস্থদের প্রায়ই বকা-ঝকা করে থাকেন। অফিসে তিনি একজন বদ মেজাজি কর্মকর্তা হিসেবেও বেশ সুবিদিত।
কেস স্ট্যাডি-২, সুমন (ছদ্ম নাম), বয়স-৩৩। বাসায় ছোট খাট ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় তার স্ত্রী ও সন্তানের সাথে তার ঝগড়া লেগে থাকে। রেগে গেলে প্রায় তিনি খুব উচ্চ স্বরে ঝগড়া করেন এবং প্রায় সময় বাসার জিনিসিপত্র ভেঙে নষ্ট করেন। তিনি প্রায় বলে থাকেন, রেগে গেলে নাকি তার মাথা ঠিক থাকে না।
রাগ-সংক্রান্ত এরূপ অসংখ্য উদাহরণ আমাদের মাঝে বিদ্যমান। সব সময় রেগে থাকেন এমন লোকের সংখ্যা যেমন বিরল নয় আবার তেমনি হুটহাট রেগে যান এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।
রাগের শারীরবৃত্তিয় কারণ: 

(১) প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্সের ভূমিকা: বাস্তবিক পক্ষে মানুষের আগ্রাসী আচরণের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হলো প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্স। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্স তুলনা মূলক কম সক্রিয় তাদের আচরণে আগ্রাসী আবেগ তথা রাগ বেশি থাকে। 
(২) টেস্টোস্টেরণ হরমোনের প্রভাব: অগ্রাসী আচরণে হরমোনের প্রভাব খুব বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে যাদের শরীরে টেস্টোস্টেরণ হরমোন উচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান, তাদের আচরণে পশুত্বের স্বভাব বিশিষ্ট বেশি পরিমাণ আগ্রসী প্রবনতা বিদ্যমান। 
(৩) নিউরোট্রান্সমিটারের ভূমিকায় পরিবর্তন : আমাদের মানসিক ভারসাম্য বজায়ে রাখতে নিউরোট্রান্সমিটার গুলোর মধ্যে সেরোটনিনের ভূমিকা অসমান্য। নিউরোট্রান্সমিটারের (যেমন: সেরোটনিন, ) ভুমিকায় যখন পরিবর্তন দেখা দেয় তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আচরণে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।
রাগ সৃষ্টির মনো সামাজিক কারণ সমূহ : রাগ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে, তন্মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- (১) ব্যক্তিত্বের গঠনগত দুর্বলতা (২) বিষণœতা নামক অসুখ (৩) এলকোহলের ব্যবহার  (৪) পরিবেশগত সমস্যা (৫) ব্যক্তির ঘুমের সমস্যা (৬) ব্যক্তির দীর্ঘদিনের কোন শারীরিক সমস্যা (৭) ব্যক্তির অতিরিক্ত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবনতা (৮) অসহোযোগিতা মূলক মনোভাব। (৯) পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেবার অক্ষমতা। (১০) বিভিন্ন মানসিক রোগজনীত সমস্যা।
রাগের শারীরিক ক্ষতিসমূহ সমূহ: রাগের কারণে ব্যক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি সমূহ বেড়ে যেতে পারে-(১) ব্যক্তির হার্ট এ্যাটাক ঝুঁকি বাড়তে পারে। (২) স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। (৩) ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। (৪) হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। (৫) বমি বমি ভাব,মাথা ঘোরানো বা কখনো কখনো গা ঘামতে পারে। 

কিছু খাবার যা ব্যক্তির রাগ নিয়ন্ত্রণে গভীর ভাবে সহায়তা করে :  

(১) ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার: প্রচুর পরিমানে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ মাছ যেমন-মলা, ঠেলা গ্রহণের ফলে আমাদের জ্ঞানীয় কার্যাবলীর উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং এ জাতীয় খাবার খেলে ক্রমে ব্রেন ফ্যাংসান উন্নত হবে এবং আগ্রসী আচরণ দিনে দিনে দূর হবে। 
(২) কলা: কলাতে প্রচুর পরিমানে পটাসিয়াম ও ভিটামিন-বি বিদ্যমান। এ দু’টি উপাদান ¯œায়ু ব্যবস্থাকে শান্ত রাখে। 
(৩) বাদাম ও বীজ: বাদাম ও বীজে প্রচুর পরিমানে ট্রিফটোফ্র্যান, জিংক এবং সেলিনিয়াম বিদ্যমান যা ব্রেন ফ্যাংসানকে উন্নত করে। 
(৪) গ্রীন টি : কোন দিন মেজাজ খারাপ থাকার জন্য যদি কাজে বিঘœ ঘটতে থাকে তবে এক কাপ গ্রীন টি খান, দেখবেন মন অনেকটা ভাল হয়ে গেছে।
(৫) ডার্ক চকলেট : ডার্ক চকলেট স্ট্রেস হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফিল্ড গুড হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায় যা মনকে শান্ত রাখতে সহায়তা করে।

রাগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী উপায় সমূহ: 

(১) গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিন এবং ছাড়তে থাকুন: যখন কারোর উপর আপনি রেগে যাচ্ছেন,তখন গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন তিন সেকেন্ড দম আটকিয়ে রেখে তারপর আস্তে আস্তে দম ছাড়–ন, দেখবেন এতে রাগ অনেকটা কমে গেছে। 
(২) মনোযোগ সরিয়ে নিন: যখন বুঝবেন আপনি করোর উপর কোন কারণে রেগে যাচ্ছেন, তখন মনকে সেই কারণ থেকে সরিয়ে অন্য কোন কাজে নিয়োজিত করে ব্যস্ত রাখুন। পছন্দের গান শুনন বা মজার মজার ভিডিও দেখুন।
(৩) নিয়মিত ব্যায়াম করুণ: প্রতিদিন সময় করে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ ও হতাশা দূর হয়। শারীরিক ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে সেরেটনিন ও এন্ডোফিন নামক উপাদান নিঃশৃত হয় যা সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
(৪) উল্টো সংখ্যা গণনা শুরু করুন: যখন মনে হয় করোর উপর আপনার রাগ সৃষ্টি হচ্ছে, তখন আপনি ১০০ হতে উল্টা সংখ্যা গণনা শুরু করতে চেষ্টা করুন। এতে আপনার রাগ কমে যেতে পারে।  
(৬) পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান: যদি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তবে সকালে মেজাজ খিট খিটে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমাতে হবে। আর ঘুম ভাল হলে ব্যক্তির মেজাজ ও ভাল থাকবে। 
পরিশেষে বলা যায়-রাগের পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধ্বংস বয়ে আনে। মনে রাখতে হবে-ভালবাসা ভালবাসা আনে আর রাগ ধ্বংস বয়ে আনে।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৩ মাস আগে