খুলনা | বুধবার | ০৫ নভেম্বর ২০২৫ | ২০ কার্তিক ১৪৩২

পলাতক আসামি প্রার্থী হতে পারবেন না, আরও যেসব পরিবর্তন এলো আরপিওতে

শুধু কেন্দ্র নয়, পুরো নির্বাচনী এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা পেল ইসি

খবর প্রতিবেদন |
০১:২৬ এ.এম | ০৫ নভেম্বর ২০২৫


নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগে সর্বোচ্চ কোনো কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারতো। তবে এবার অনিয়ম হলে ইসি পুরো নির্বাচনি এলাকার ফলাফল বাতিল করতে পারবে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন বিধান রেখেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করেছে সরকার। সোমবার আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে।
অনুচ্ছেদ ৯১ এ বলা হয়েছে, অনিয়মের জন্য কেন্দ্রের ভোট বাতিলের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে পুরো নির্বাচনী এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে। আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দন্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান রয়েছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিধান রয়েছে। হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে ইসিকে ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন যেসব বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে তা উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করে। দলগুলোর দাবির মধ্যেও এরপর আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির সই হলে তা সংশোধন অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।
সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তাতে একগুচ্ছ পরিবর্তনের পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন বিধানও। এই সংশোধিত আরপিও ধরেই শিগগিরই দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা চূড়ান্ত করবে নির্বাচন কমিশন।
নতুন আরপিও অনুযায়ী, আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি ভোট করতে পারবেন না এমন বিধান যোগ হয়েছে এবার। দেড় দশক পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় যেমন সশস্ত্র বাহিনী ফিরেছে, তেমনই ‘না’ ভোট ব্যবস্থা এবার এসেছে একক প্রার্থীর আসনে।
সমভোট পেলে হবে পুনঃভোট, জোটে করলেও ভোট করতে হবে নিজ দলের মার্কায়, জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা পুনর্র্নিধারণ, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি চালু করা, অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধান, এআইয়ের অপব্যবহারকে নির্বাচনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য (ভোটে অযোগ্য এমন) দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও ইসি ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে আরপিওতে বলা হয়েছে।
২ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর নাম যুক্ত করা হয়েছে। ২০০১ ও ২০০৮ সালের ভোটে এমন বিধান ছিল। গত তিন নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় ছিল সশস্ত্র বাহিনী। এবার সংশোধন হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হতে পারে।
৮ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্র (পোলিং স্টেশন) প্রস্তুতের ক্ষমতা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার হাতে রাখা হয়েছে। তারা তালিকা করে কমিশনের অনুমোদন নেবেন।
৯ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করা হয়েছে; রিটার্নিং অফিসার কোনো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করলে তা ইসিকে অবহিত করতে হবে।
১২ নম্বর অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে আদালত কাউকে ফেরারি বা পলাতক আসামি ঘোষণা করলে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন। ফলে পলাতক আসামি প্রার্থী হতে পারবেন না এবার।
সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে থাকলেও প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।
কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদকে ‘লাভজনক’ পদ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে আরপিওতে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পদে থেকে ভোটে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে না।
হলফনামায় দেশে এবং বিদেশে আয়ের উৎস থাকলে তা জানাতে হবে; দাখিল করতে হবে সবশেষ বছরের রিটার্ন।
প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য সংক্রান্ত হলনামায় অসত্য তথ্যের প্রমাণ পেলে ভোটের পরেও ইসির ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা যুক্ত করা হয়েছে।
১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া জামানতের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে এর পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টাকা।
১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তার আদেশে ক্ষুব্ধ হলে প্রার্থী বা ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোনো সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানও আপিল করার সুযোগ পাবে।
১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কোনো আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী যদি একজন থাকে, তাহলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান থাকবে। তবে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত একক প্রার্থী থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
২০ নম্বর সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত একাধিক রাজনৈতিক দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীক বা মার্কায় ভোট করতে হবে।
২১ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করে বলা হয়েছে নির্বাচনী এজেন্টকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে।
২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রিজাইডিং অফিসারের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ভোটগ্রহণ বাধাগ্রস্ত বা বিঘিœত হওয়ার ক্ষেত্রে ভোট স্থগিতের পর তা নির্ধারিত সময়ে শুরু না করা গেলে বা ব্যালট বাক্স খোয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রিজাইডিং অফিসার তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে ভোটের নতুন দিন ঘোষণা করবে ইসি।
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি, তার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ‘ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান’ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। প্রবাসী, নির্বাচনী এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি চাকুরিজীবী এবং কারাগারে বা হেফাজতে থাকা ব্যক্তি পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন।
২৯ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করে ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ভোট গণনার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিত থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণনার ফল যোগ করার আগে রিটার্নিং কর্মকর্তা ‘প্রয়োজন মনে করলে’ প্রিজাইডিং অফিসারের হাতে বাতিল হওয়া ভোট পরীক্ষা করতে পারবেন। তিনি যদি এমন ব্যালট পান-যা বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি, সেটি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভোট হিসাবে গণ্য হবে।
৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সমভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট করা যাবে। আগে সমভোট প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে লটারি করে একজনকে নির্বাচিত করার বিধান ছিল।
নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করে ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিমার্জন করা হয়েছে। ভোটার প্রতি ব্যয় সর্বোচ্চ ১০ টাকা ঠিক করা হয়েছে। তবে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার বেশি হওয়া যাবে না।
অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থের তালিকা বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট করে ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক বা ডিআইজি পদমর্যাদা পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলির তথ্য ইসিকে জানাতে হবে।
৭৩ নম্বর অনুচ্ছেদে মিথ্যা তথ্য, অপতথ্য, গুজব এবং এআইয়ের অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলের বিষয়ে অপরাধের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
৭৪, ৮১, ৮৭ ও ৮৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ছোটখাট পরিমার্জন আনা হয়েছে।
দল নিবন্ধন ও আর্থিক অনুদানের বিষয় এবং নিবন্ধন স্থগিত হলে প্রতীক স্থগিতের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে ৯০ নম্বর অনুচ্ছেদে।
৯১ নম্বর অনুচ্ছেদে অনিয়মের জন্য কেন্দ্রের ভোট বাতিলের পাশাপাশি প্রয়োজনে পুরো নির্বাচনী এলাকার ফল বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের দন্ডের পাশাপাশি সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দলের ক্ষেত্রেও জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের সময় গণভোট প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য ও সরকারি সিদ্ধান্ত এলে ইসির কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমের পাশাপাশি ইসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ব্যবস্থা নিতে পারবেন-এমন বিধান রাখা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে হলফনামায় অসত্য তথ্যে যাচাই ও ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে।
আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারির মধ্যে নির্বাচনী আইনের সব ধরনের সংস্কার কাজ শেষ হল। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধন, ভোটকেন্দ্র নীতিমালা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, সাংবাদিক নীতিমালাসহ সব ধরনের আইন-বিধি সংস্কার করেছে ইসি।
আরপিও সংশোধন হওয়ায় এর আলোকে দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা শিগগিরই জারি করবে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী নিবন্ধিত দল জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।
এর আগে ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন করে। এরপর জোট মনোনীত প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করা নিয়ে বিএনপি আপত্তি তুললেও জামায়াত ও এনসিপি ২০ ধারার এ সংশোধন বহাল রাখার দাবি জানায়।
এ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যেই সেই বিধান রেখেই অধ্যাদেশ জারি করা হলো। ফলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে একাধিক নিবন্ধিত দল জোট করলেও জোট মনোনীত প্রার্থী বড় দলের বা অন্য দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না, নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ