খুলনা | শুক্রবার | ২৮ নভেম্বর ২০২৫ | ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

শেখ হাসিনার স্বর্ণ জব্দ, নতুন তথ্য

খবর প্রতিবেদন |
০১:৫৮ এ.এম | ২৭ নভেম্বর ২০২৫


অগ্রণী ব্যাংকে দু’টি লকার থেকে ৮৩২ ভরি সোনা পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে একটি লকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের নামে। অন্যটি শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার নামে।
দুদক বুধবার বলেছে, অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদের নামে থাকা একটি লকারে ৪২২ ভরির কিছু বেশি সোনা পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে থাকা একটি লকারে পাওয়া গেছে ৪১০ ভরি সোনা।
পূবালী ব্যাংকেও শেখ হাসিনার নামে একটি লকার থাকার কথা জানিয়েছে দুদক। সেখানে পাওয়া গেছে একটি ছোট চটের ব্যাগ। সেটি খালি ছিল।
দুদক বলছে, লকারের রক্ষিত চিরকুট ও বর্ণনা অনুযায়ী স্বর্ণালঙ্কারগুলো শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানা ও তাঁর ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সংস্থাটি সোনার মালিকানা সুনির্দিষ্ট করে আইনগত দায় নিরূপণ করবে বলে জানিয়েছে।
বুধবার সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মোঃ আক্তার হোসেন এসব তথ্য জানান।
দুদকের মহাপরিচালক মোঃ আক্তার হোসেন জানান, দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী পুনঃযাচাইয়ের অংশ হিসেবে হাসিনা ওয়াজেদের নামে থাকা দু’টি ব্যাংকের তিনটি লকার খুলে ৯ কেজি ৭০৭ গ্রাম (৮৩২ ভরি) স্বর্ণ উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।  দেখা গেছে, স্বর্ণের চুরি, নৌকা, ও কানের দুলসহ অন্যান্য অলঙ্কার রয়েছে।
দুদক মহাপরিচালক জানান, ভল্টে থাকা নথি এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে যে জব্দকৃত স্বর্ণালংকারের মধ্যে কিছু অংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত, আবার কিছু অংশ তার বোন এবং মেয়ের ব্যক্তিগত সম্পদ।
তিনি বলেন, ‘স্বর্ণালঙ্কারগুলো আলাদা আলাদাভাবে মার্কিং (চিহ্নিত) করা ছিল। আমাদের অনুসন্ধানকারী দলের কর্মকর্তারা এখন স্বর্ণালঙ্কারগুলো আলাদা করবেন। কার কোন অংশটুকু আছে, তা নির্ধারণ করা হবে।’
মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে অংশগুলো থাকবে, সেগুলো এই অনুসন্ধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেগুলো তারা বিবেচনা করবেন। অন্যগুলো অন্য অনুসন্ধানের অংশ হতে পারে।’
জব্দ করা ৮৩২ ভরি স্বর্ণালংকারের মধ্যে শেখ হাসিনার কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেই অংশটুকু নির্ধারণ করার জন্যই ইনভেন্ট্রি করা হয়েছে এবং তার যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করে তার অংশটুকু নির্ধারণ করা হবে। তার জন্যই এত কার্যক্রম।’
দুদকের চোখে জব্দ হওয়া এসব স্বর্ণ বৈধ না অবৈধ-জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘সম্পদ বিবরণী যাচাই করলে জানা যাবে স্বর্ণগুলো জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না।’ যদি আয়ের উৎস জানা না যায় বা তা বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তবেই তা অবৈধ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
শেখ হাসিনার সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনার আলোকে এই সম্পদ জব্দ করা হবে কি না এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা ভিন্ন জিনিস। আদালতের একটা আলাদা আদেশ রয়েছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও বিধির আলোকে আমাদের অনুসন্ধান দল এই কার্যক্রম ঠিক করে আদালতের অনুমতিক্রমে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে, সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জব্দ সোনা কি শেখ হাসিনার হলফনামায় দেখানো হয়েছিল? : ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে শেখ হাসিনা হলফনামা জমা দিয়েছিলেন। তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওয়েবসাইটে শেখ হাসিনার হলফনামাটি এখনো আছে। তাতে দেখা যায়, তিনি নিজের নামে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছিলেন। সোনা ও মূল্যবান ধাতুর অর্জনকালীন মূল্য দেখিয়েছিলেন ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সেখানে সোনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি।
শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ও হলফনামায় সোনা ও মূল্যবান ধাতুর মূল্য বাবদ ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখিয়েছিলেন।
আয়, সম্পদসহ আট ধরনের তথ্য হলফনামায় দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকেই।
দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের হলফনামায় শেখ হাসিনার সম্পদের মধ্যে সোনা ও মূল্যবান ধাতুর মূল্যে কোনো হেরফের নেই।
শেখ হাসিনার আয়কর বিবরণীতেও সোনা ও মূল্যবান ধাতুর শুধু মূল্য দেখানো হয়েছে, পরিমাণ নয়। যদিও আয়কর বিবরণীতে পরিমাণ ও দাম দু’টোই দেখানোর জন্য ফরমে বলা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা দুষ্কর যে ৮৩২ ভরির মধ্যে শেখ হাসিনার অংশ কত এবং তার পুরোটা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছিল কি না। কারণ, তিনি হলফনামায় সোনার পরিমাণ উল্লেখ করেননি এবং তা অর্জনের সময়ও জানাননি।
বর্তমান বাজার মূল্যে ৮৩২ ভরি সোনার দাম ১৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার মতো। এই দাম হিসাব করা হয়েছে সোনার মান ২২ ক্যারেট ধরে। বর্তমানে ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিপ্রতি ২ লাখ ৮ হাজার টাকা।
অতীতে দেশে সোনার দাম অনেক কম ছিল। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) হিসাবে, ১৯৭২ সালে দেশে এক ভরি সোনার দাম ছিল ১৬০ টাকা। তা বেড়ে ১৯৭৭ সালে ১ হাজার ৫০০ টাকা হয়। ১৯৯০ সালে সোনার ভরি ছিল ৬ হাজার ২০০ টাকা। ২০০০ সালে তা কমে হয় ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। যদিও এর পর থেকে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
লকারে কি অন্য কারও সম্পদ রাখা যায় : মূল্যবান সামগ্রী রাখার জন্য ব্যাংকগুলো লকার ভাড়া দিয়ে থাকে। ভাড়ার হার ব্যাংকভেদে ভিন্ন। একটি ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, তারা বড় লকার বছরে ৮ হাজার টাকা, মাঝারি লকার ৬ হাজার টাকা এবং ছোট লকার ৪ হাজার টাকায় ভাড়া দিচ্ছে।
দেশের সুপরিচিত একটি ব্যাংকের লকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লকারে কী রাখবেন, তা নির্ভর করে গ্রাহকের ওপর। লকারের দুটি চাবি থাকে। একটি ব্যাংকের কাছে, আরেকটি গ্রাহকের কাছে। গ্রাহক লকার খুলতে চাইলে দু’টো চাবিই লাগে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক লকার খুলে দিয়ে চলে যায়। এরপর গ্রাহক তাঁর মূল্যবান সামগ্রী রাখেন কিংবা নিয়ে যান।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রাহক কখন লকার খুলতে এলেন, কখন গেলেন, তা ব্যাংকের লগ বইতে সংরক্ষণ করা হয়।
লকারে কি অন্য কারও সম্পদ রাখা যায়, এ প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লকারের ভাড়াগ্রহীতা লকারে কার সম্পদ রাখবেন, সেটা তাঁর বিষয়। তবে আয়কর কর্মকর্তারা ধরে নেন, যে ব্যক্তি ভাড়া নিয়েছেন, লকারে রাখা সম্পদ তাঁরই।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি দাবি করেন যে সম্পদ তাঁর নয়, অন্য কারও, তাহলে সেই প্রমাণ তাঁকে দেখাতে হবে। আবার যে ব্যক্তির সম্পদ হিসেবে বলা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির আয়কর বিবরণীতে তা উল্লেখ আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখে এনবিআর। ফলে মর্জিমতো দাবি করার সুযোগ নেই।
আদালতের অনুমতিতে এর আগে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রাতে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যৌথ টিম লকার দু’টি খুলে এসব স্বর্ণালংকার জব্দ করে।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখায় (সাবেক স্থানীয় কার্যালয় শাখা) শেখ হাসিনার দু’টি লকার জব্দ করে সিআইসি। ৭৫১ ও ৭৫৩ নম্বর লকার দু’টি কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে জব্দ করা হয়। রাজধানীর সেনাকল্যাণ ভবনে অবস্থিত পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখার ১২৮ নম্বর লকারটিও গত ১০ সেপ্টেম্বর জব্দ করে সিআইসি।

্রিন্ট

আরও সংবদ