খুলনা | বুধবার | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

ভিন্নমতকে স্বাগত জানাচ্ছে ফেসবুকের নতুন ‘না’ বাটন

জয়া মাহবুব |
১২:২২ এ.এম | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫


অনলাইন সৌজন্যের নতুন দিগন্ত: ‘লাইক’ এখন আর সবকিছুর একমাত্র উত্তর নয়, যুক্ত হলো ‘না’-এর পরিশীলিত ভাষা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগের ভাষা এবার এক নতুন মোড় নিল। দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মেটা প্ল্যাটফর্মস (ফেসবুক) পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে বহু প্রতীক্ষিত ‘না’ বাটন। একসময় যেখানে প্রতিটি পোস্টের নিচে কেবল ‘লাইক’ বাটনটিই ছিল একমাত্র প্রতিক্রিয়া, সেখানে এখন ভিন্নমত প্রকাশের একটি মার্জিত উপায় পেলেন ব্যবহারকারীরা। এই সংযোজন কেবল একটি নতুন আইকন নয়, বরং ডিজিটাল যুগে আলোচনার ভারসাম্যতা এবং অনলাইন সৌজন্যের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘না’ বাটনের নেপথ্যের গল্প : ২০০৯ সালে যখন ‘লাইক’ বাটন চালু হয়, তখন তা রাতারাতি সামাজিক যোগাযোগের এক বৈশ্বিক প্রতীকে পরিণত হয়। এরপর ২০১৬ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভালোবাসা, রাগ, হাসি, দুঃখ বা সহানুভূতির মতো নানা রিঅ্যাকশন। কিন্তু ‘ডিসলাইক’ বা সরাসরি দ্বিমত প্রকাশের একটি বাটনের দাবি ছিল ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো।
দীর্ঘদিন ধরে মেটা কর্তৃপক্ষ এই দাবি এড়িয়ে যাচ্ছিল। তাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল-ফেসবুক যেন নেতিবাচকতা, ট্রল বা সাইবারবুলিংয়ের প্ল্যাটফর্মে পরিণত না হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীরা অনুভব করেছেন যে, কোনো মতামত, ছবি বা ভাবনার সঙ্গে একমত না হলেও, কেবল সৌজন্য রক্ষার খাতিরে ‘লাইক’ দিয়ে দেওয়াটা একধরনের স্ববিরোধিতা।
ব্যবহারকারীরা এখন শুধু প্রশংসা নয়, বরং ভদ্র ও যুক্তিযুক্তভাবে মতভেদও প্রকাশ করতে চান। এই প্রেক্ষাপটেই এসেছে ‘না’ বাটন, যা নিছক ‘ডিসলাইক’ নয়, বরং ‘সৌজন্যপূর্ণ দ্বিমত’ প্রকাশের একটি উপায়।
ফিচারটি যেভাবে কাজ করবে : বর্তমানে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া এই ফিচারটি ব্যবহারকারীদের কমেন্ট বা নির্দিষ্ট পোস্টে ‘না’ রিঅ্যাকশন দেওয়ার সুযোগ করে দেবে।
ফেসবুকের অ্যালগরিদম এই নতুন প্রতিক্রিয়াকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো এমন কনটেন্ট ব্যবহারকারীদের থেকে দূরে রাখা, যা তাদের পছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ, এই বাটনটি মূলত কনটেন্ট ফিডকে আরও ব্যক্তিগত, প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহারকারীর রুচি অনুযায়ী উপযোগী করে তুলবে।
সামাজিক পরিপক্বতার নতুন ভাষা : মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই ‘না’ বাটন একটি গভীর সামাজিক তাৎপর্য বহন করে। আমরা প্রায়শই কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে অনলাইন কথোপকথন পর্যন্ত যেকোনো স্থানে ‘না’ বলতে ভয় পাই। কিন্তু ভদ্রভাবে মতভেদ প্রকাশ করা সামাজিক পরিপক্বতার একটি অপরিহার্য অংশ।
ফেসবুকের এই পদক্ষেপ অনলাইন আলোচনাকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারে। এটি হয়তো আমাদের শেখাবে যে, অমত মানেই আক্রমণ নয়, বরং আলোচনার শুরু। মানুষ একমত না হলেও, একে অপরের মতামতকে সম্মান জানাতে শিখবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই কোনো না কোনোভাবে স্বীকৃতি খোঁজেন। একটি ‘লাইক’ যেখানে তাৎক্ষণিক আনন্দের উৎস, সেখানে ‘না’ হতাশার কারণ হতে পারে। এই ফিচারটি আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি করবে-সবাই যে আমাদের সঙ্গে একমত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এটি সমালোচনাকেও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণের আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
দায়িত্বশীল ব্যবহারের আহŸান : বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিবর্তন যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি এর দায়িত্বশীল ব্যবহারও সমান জরুরি। মূল উদ্বেগটি থেকেই যাচ্ছে-এই ফিচার কি অপব্যবহার হবে? কেউ কি ইচ্ছাকৃতভাবে অপছন্দ প্রকাশ করে মানসিকভাবে আঘাত করবে?
ডিজিটাল যুগে যোগাযোগের ভাষা বদলাচ্ছে। একসময় যেখানে ‘লাইক’ আমাদের একত্রিত করেছিল, ‘না’ হয়তো আমাদের আলাদাভাবে ভাবতে শেখাবে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে যদি সম্মান ও সৌজন্য বজায় থাকে, তাহলে এটিই হবে সভ্যতার পরিপূর্ণতা।
ফেসবুকের এই নতুন সংযোজন নিঃসন্দেহে সামাজিক মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর আলোচনার এক নতুন দরজা খুলে দিতে পারে। এটি আমাদের শেখাবে, ভিন্নমতও সৌজন্যের সঙ্গে বলা যায়, এবং ‘না’ মানে সবসময় নেতিবাচকতা নয়।

্রিন্ট

আরও সংবদ