খুলনা | বুধবার | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন

বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকান্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় তাপসের অফিসে

খবর প্রতিবেদন |
০১:৪৫ এ.এম | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫


২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারি বিজিবির (আগের নাম বিডিআর) সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় দলগতভাবে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা পেয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস এ ঘটনার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন বলে অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। নৃশংস এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ১১ মাস ধরে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করে কমিশন। রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিশন।
প্রতিবেদন দেওয়ার পর সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অবঃ) আ ল ম ফজলুর রহমান প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিডিআর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিডিআর সদস্যদের মধ্যেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ছিল বলেও কমিশন প্রধান জানান।
পিলখানায় সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। সব মিলিয়ে তখন পিলখানায় নিহত হন ৭৪ জন। সেদিন পিলখানায় থাকা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও নৃশংসতার শিকার হন।
ফজলুর রহমান বলেন, এ ঘটনার আদ্যোপান্ত তারা বের করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের তদন্তে উঠে এসেছে-বিডিআর হত্যাকান্ডে কারা জড়িত, কারা আলামত নষ্ট করেছে, এর স্বরূপ কী, কেন এটা হলো, কারা দায়ী, কীভাবে প্রতিরোধ করা যেত অথবা প্রতিরোধ করা যেত কি যেত না। তিনি বলেন, তদন্তে এটাও উঠে এসেছে-কেন সেনাবাহিনী সামরিক পদক্ষেপ নিলো না, কেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলো এবং কীভাবে ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছিল? পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের তথ্যও বের হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি বিডিআর সদর দফতরে ঘটে যায় বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় এক হত্যাকান্ড। বিডিআরের কিছু বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের হাতে বিডিআরের মহাপরিচালকসহ নির্মমভাবে প্রাণ হারান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন। কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের দ্বারা কান্ডজ্ঞানহীন এই বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটনের মাধ্যমে বাহিনীটির সুদীর্ঘ ২১৫ বছরের গৌরবময় ইতিহাসের ছন্দপতন ঘটে। এ ঘৃণ্য ও কলঙ্কময় ঘটনা কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বে একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বিডিআর বাহিনীর নাম, পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের প্রস্তাব তৎকালীন সরকার কর্তৃক ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং যা ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘বিজিবি আইন ২০১০’ নামে পরিচিত। ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয় ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ নামে এ বাহিনীর নতুন পথচলা। বাংলাদেশ রাইফেলস্ এর সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর সাংগঠনিক কাঠামো প্রস্তুত করা হয়।
হত্যাকান্ডের আগে আ’লীগ নেতাদের সঙ্গে বিডিআর সদস্যদের যোগাযোগ : কয়েদি সাক্ষী নম্বর-১৪, ২৫ এবং বিডিআর সাক্ষী নম্বর-০৩-এর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকা-৯ আসনের আওয়ামী-লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস তার প্রচারণার স্বার্থে বেশ কয়েকবার পিলখানায় জুম্মার নামাজ পড়তে যান। তার সঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফোরকান (প্রাক্তন অধিনায়ক ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন), মেজর রেজাউল ইসলাম (প্রাক্তন উপ-অধিনায়ক ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন) এবং সিপাহী মইনুদ্দিন বসতেন। মেজর রেজার সঙ্গে সিপাহী মইনুদ্দিনের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। মসজিদে নামাজ শেষ হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফোরকান মুয়াজ্জিনকে বলত যে আপনি জানালা বন্ধ করে চলে যান, আমাদের কথাবার্তা শেষ হলে দরজা বন্ধ করে চলে যাব। বিষয়টি লে. কর্নেল ফোরকান আহমেদ ও মেজর রেজাউল ইসলাম উভয়েই অস্বীকার করেছেন (সূত্রঃ সাক্ষী নম্বর-১০৭ এবং সাক্ষী নম্বর-১১৭)।
‘মরহুম মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান (পিলখানায় কেন্দ্রীয় মসজিদের ভারপ্রাপ্ত পেশ ইমাম) এর স্ত্রী কামরুন নাহার শিরীনের ভাষ্যমতে তার স্বামী তাকে বলেছেন যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই ফজলে নূর তাপস পিলখানার সেন্ট্রাল মসজিদে কয়েকজন সৈনিক এবং ডিএডি পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করতেন। ঘটনার পর তিনি তার স্বামীকে একদম ভেঙে পড়তে দেখেন এবং বলতে শোনেন ‘এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন তারা মসজিদে বৈঠক করছিল। মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমাকে বের করে দিয়ে তারা কথা বলত। এখন বুঝতে পারছি কেন তারা এসব করতো’ (সূত্রঃ বিডিআর সাক্ষী নম্বর-০৩)।
কয়েদি সাক্ষী নম্বর-১৪  এর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার দিন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পিলখানার ৫ নং গেট দিয়ে প্রবেশ করে পিলখানার ভেতরে, দরবার হলের পাশের মাঠে একটা জনসভার মতো করে। সেই সভায় ২০০ জনের মতো বিডিআর সদস্য অংশ নিয়েছিল। সেখানে ব্যারিস্টার তাপস বলেন যে আপনাদের তো অনেক দাবি-দাওয়া এবং অভাব-অভিযোগ আছে। তবে এখানে সব কথা আলোচনা করা যাবে না। আপনারা আমার চেম্বারে আসবেন। এর কিছুদিন পরে ১০-১৫ জন বিডিআর সদস্যের একটা দল তোরাব আলী ও তার ছেলে লেদার লিটনের নেতৃত্বে ব্যারিস্টার তাপসের চেম্বারে দেখা করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিডিআর সৈনিকদের সঙ্গে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল যুবলীগ নেতা জাকির, লেদার লিটন এবং আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলী। তোরাব আলীর বরাতে নায়েক শেখ শহীদুর রহমান-এর ভাষ্য, ‘শেখ সেলিম এবং তাপস অনেকবার তোরাব আলীকে ডেকে বিডিআরের সৈনিকদের অবস্থা এবং দাবি-দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছে। এরপর শেখ সেলিম তোরাব আলীকে দায়িত্ব দিয়েছে বিডিআর সৈনিকদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে আরো খোঁজ নিতে এবং তাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। সেসময় শেখ সেলিমের সঙ্গে ব্যারিস্টার তাপসও উপস্থিত ছিল।’
নায়েক শেখ শহীদুর রহমানকে তোরাব আলীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শেখ সেলিমের সঙ্গে বিডিআর সৈনিকদের পরিকল্পনা হয়েছিল মূলত অফিসারদের জিম্মি করার। এরপর সোহেল তাজ এবং শেখ সেলিমের উপস্থিতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’এর ২৪ জনের একটি কিলার গ্র“পের সঙ্গে বৈঠক হয়। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ওপর দায়িত্ব ছিল কিলারসহ বিডিআর সৈনিকদের নিরাপদে পালানোর সুযোগ করে দেয়ার। ভারতীয়দের সঙ্গে বৈঠকের পরে পুরো পরিকল্পনা সাজানো হয় এবং সমন্বয় করার জন্য তাপসের বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, লেদার লিটন এবং তোরাব আলী। সেখানে যখন জানানো হয় যে, অফিসারদের হত্যা করা হবে, তখন তোরাব আলী সেখানে আপত্তি করে। সে বলে যে অফিসারদের হত্যা করা যাবে না। তখন শেখ সেলিম তাকে মুরুব্বি সম্বোধন করে বলেন, ‘আপনার তো বয়স হয়েছে। আপনার আর এর মধ্যে থাকার দরকার নাই। আপনার ছেলে আমাদের সঙ্গে থাকলেই হবে।’
৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন এর সিও কর্নেল শামস এই বিষয়গুলো জানতেন এবং তিনিও শেখ সেলিম এবং তাপসের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে সৈনিকদের সহায়তা করেছেন (সূত্রঃ কয়েদি সাক্ষী নম্বর-২৪)।
কয়েদি সাক্ষী নম্বর-২৫ এর বরাত দিয়ে বলা হয়, ঝাড়ুদার আব্দুল হাকিম অন্তত তিন দিন দেখেছেন যে ফজলে নূর তাপস ডিএডি তৌহিদের সঙ্গে এবং আরো সৈনিকদের সঙ্গে নামাজের পরে মসজিদের ভেতরে বৈঠক করছে। ফজলে নূর তাপস মাঝে মাঝে ভোট চাইতে পিলখানায় আসতেন এবং ভোটের দিনও পিলখানায় এসেছিলেন। ভোটের দিন অনেক সৈনিকসহ ঝাড়ুদার আব্দুল হাকিমকেও জড়িয়ে ধরে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে অনুরোধ করেছেন।
কয়েদি সাক্ষী নম্বর-১৪ এর বরাত দিয়ে বলা হয়, নির্বাচনের পরে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আলম চৌধুরী কমান্ডিং অফিসার অধিনায়ক হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। সিপাহী সেলিম যেহেতু অফিস ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তাই লেঃ কর্নেল শামস তাকে চিনতেন। একদিন ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে লেঃ কর্নেল শামস সিপাহী সেলিমকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা তো তোমাদের দাবি-দাওয়ার কথা বললে কিন্তু কোনো কাজ তো হলো না। তোমরা শেখ সেলিমের সঙ্গে দেখা কর। তোমাদের সঙ্গে শেখ সেলিমের দেখা করার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।’ ওই সময় লেঃ কর্নেল শামস শুধু সিপাহী সেলিমকেই ডেকেছিলেন, আর কেউ ছিল না।
পরবর্তীতে সিপাহী সেলিম এবং মইনুদ্দিনসহ আরো ২০-২২ জন (সিপাহী সেলিমের ১৬৪ ধারা জবানবন্দি অনুসারে এখানে ছিল সিপাহী মইনুদ্দিন, ল্যান্স নায়েক শাহাবুদ্দিন, সিপাহী কাজল, হাবিলদার মনির, সিপাহী আইয়ুব, সিপাহী মেহেদি, সিপাহী সাজ্জাদ, সিপাহী আরপি রেজাউল, প্রিম কোচিং সেন্টারের জাকির, ডিএডি হাবিব, ডিএডি জলিল) শেখ সেলিমের বনানীর বাসায় ১৩  ফেব্র“য়ারি দেখা করে। মইনুদ্দিন শেখ সেলিমের বাসার গেটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের কথা বলতেই সবাইকে গেস্টরুমে বসতে দেয় এবং কিছুক্ষণ পর শেখ সেলিম নেমে আসেন। শেখ সেলিমের কাছে মইনুদ্দিন তাদের দাবি-দাওয়া যেমন নিজস্ব অফিসার, ডাল-ভাতের দুর্নীতি, ১০০ শতাংশ রেশন, বিদেশ মিশন ইত্যাদি তুলে ধরে। এসব আলোচনা শেষে শেখ সেলিম মইনুদ্দিনকে বলেন যে তিনি সবকিছু প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল পেলে তা তাদেরকে জানানো হবে। তিনি বলেন, ‘তোমরা অফিসারদের জিম্মি করে রাখবা। এরপর কী কী করতে হয় আমরা করব। তোমাদের দাবি-দাওয়া কীভাবে আদায় করতে হয়, আদায় করে দেব।’ (সূত্রঃ কয়েদি সাক্ষী নম্বর-১৪ এর ১৬৪ ধারা জবানবন্দি প্রদর্শিত বস্তু, সংযোজনী-০৮)।
ফজলে নূর তাপস ১৬১ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দিতেও স্বীকার করেছেন যে তার কাছে বিডিআর সদস্যরা দাবি-দাওয়া নিয়ে এসেছিল। তিনি বিডিআর সদস্যদের দাবি-দাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন এবং পরবর্তীতে নিশ্চিত করেন যে তিনি দাবি-দাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন (সূত্রঃ ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের ১৬১ ধারা জবানবন্দী, সংযোজনী-০৯)।
কয়েদি সাক্ষী নম্বর-১৪ এর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওইদিনই (২০ বা ২১ জানুয়ারি) সিপাহী সেলিমরা শেখ সেলিমের বাসা হতে চলে যাওয়ার পরে সোহেল তাজের নেতৃত্বে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এবং শেখ সেলিমের নিজস্ব কিছু লোকজন নিয়ে বিডিআর সংক্রান্ত আরো একটি বৈঠক হয়। ২২ বা ২৩ ফেব্র“য়ারি মইনুদ্দিনকে শেখ সেলিম জানায় যে প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেছে।
এনএসআই সাক্ষী নম্বর-১ এর বরাতে বলা হয়, এনএসআইয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক টিএফআই সেলে কাজ করার সময় বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেন যে, শেখ সেলিম, ব্যারিস্টার তাপস, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে বিদ্রোহের পূর্বে বিডিআর জওয়ানরা নিয়মিত সাক্ষাৎ করেছেন। শেখ সেলিম তখন আর্মি অফিসারদের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘জওয়ানরা দাবি আদায়ে দুই-একজনকে মেরেও ফেললে সমস্যা নেই’।
কয়েদি সাক্ষী নাম্বার ২৪ এর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির ৫ নম্বর সংযোজনীর বরাতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যায় ডিএডি হাবিবের গাড়িতে করে সিপাহী সেলিম, ডিএডি জলিল, ডিএডি হাবিব এবং আরো কয়েকজন বিডিআর সৈনিক তেজকুনিপাড়ায় হোটেল ইমপেরিয়াল-এ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাওয়ায় তারা পরেরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেইলি রোডের বাসায় যায় কিন্তু সেইদিনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা হয়নি। এভাবে দুই তিনবার চেষ্টার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে না পেরে তাদের ৫৫টি দাবি-দাওয়া সম্বলিত একটি দাবিনামা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএসের কাছে দিয়ে আসেন। ২৩ ফেব্র“য়ারি সিপাহী সেলিম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে এপিএসের কাছে প্রদত্ত তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানান যে, তিনি দাবিগুলো দেখার সময় পাননি।
তাপসের অফিসে বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা : ‘তোরাব আলীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শেখ সেলিমের সঙ্গে বিডিআর সৈনিকদের পরিকল্পনা হয়েছিল মূলত অফিসারদের জিম্মি করার। এরপর সোহেল তাজ এবং শেখ সেলিমের উপস্থিতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ২৪  জনের একটি কিলার গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক হয়। ফজলে নূর তাপসের ওপর দায়িত্ব ছিল কিলারদেরসহ বিডিআর সৈনিকদের নিরাপদে পালানোর সুযোগ করে দেওয়ার।’ বিডিআর সদস্যরা ছাড়াও এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, লেদার লিটন এবং তোরাব আলী। সেখানে যখন জানানো হয় যে অফিসারদের হত্যা করা হবে, তখন তোরাব আলী সেখানে আপত্তি করে। সে বলে যে অফিসারদের হত্যা করা যাবে না। তখন শেখ সেলিম তাকে ‘মুরুব্বি’ সম্বোধন করে বলেন, ‘আপনার তো বয়স হয়েছে। আপনার আর এর মধ্যে থাকার দরকার নাই। আপনার ছেলে আমাদের সঙ্গে থাকলেই হবে’ (সূত্রঃ কয়েদি সাক্ষী নম্বর-২৪)। আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে বৈঠকের পরে তোরাব আলীর মাধ্যমে বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্যে বিডিআর সদস্যদের মাঝে বিপুল টাকা বিতরণ করা হয় (সূত্রঃ সাক্ষী নম্বর-৯৪ ভিডিও সাক্ষ্য এবং শহীদ পরিবার সাক্ষী নম্বর-১১)। 
৬৬ নম্বর সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারি হত্যাকান্ডের ঘটনার আগে মেজর (পরবর্তীতে লেঃ কর্নেল) রওশনুল ফিরোজ মেজর খন্দকার আব্দুল হাফিজ (অবঃ)-কে বেশ কয়েক শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে ডিএডি নাসিরের সঙ্গে অফিসার বাসস্থানের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেন। একবার ডিএডি জলিলও সেখানে ছিলেন। একদিন মেজর রওশনুল ফিরোজ মেজর খন্দকার আব্দুল হাফিজকে জিজ্ঞেস করেন ডিএডি নাসির তার (মেজর হাফিজ) আত্মীয় কি-না। উত্তরে মেজর হাফিজ বলেন ডিএডি নাাসিরের সঙ্গে তার শুধু পরিচয় আছে।
২৫-২৬ ফেব্র“য়ারির আগে খুনিদের বৈঠক : ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যায় ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের মাঠে সিপাহী মইনুদ্দিন, সিপাহী শাহাদাত (১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন), সিপাহী রুবেল (১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন), সিপাহী মিজান (৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন), সিপাহী হাসিবুল, সিপাহী কাজলসহ ১৪/১৫ জন জমা হয়। সেখান থেকে ৫নং গেট দিয়ে বের হয়ে আনুমানিক ১০০ গজ সামনে একটি টিনশেড বিল্ডিংয়ের খালি বাসাতে ৩০/৩৫ জন মিটিং করে। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ২৫ ফেব্র“য়ারি সকাল ৭টায় সবাই ৪৪ ব্যাটালিয়নের মাঠে সমাবত হয়ে কোত ও ম্যাগাজিন লুট করে অফিসারদের জিম্মি করা হবে। অফিসারদের রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল ও কলেজে জিম্মি করে রেখে সরকারকে জানিয়ে দাবি আদায় করা হবে। (সূত্রঃ কয়েদি সাক্ষী-১৪ ও কয়েদি সাক্ষী-২২ এর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী সংযোজনী-৮)।

্রিন্ট

আরও সংবদ