খুলনা | শুক্রবার | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

পিলখানা হত্যার আগের রাতে রশি-চাকু নিয়ে জিম্মির ‘গোপন পরিকল্পনা’

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৭ এ.এম | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫


২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দফতরে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাযজ্ঞের আগের রাতেই সৈনিকরা অফিসারদের জিম্মি করার গোপন পরিকল্পনা করেছিল। ২৪ ফেব্র“য়ারি রাতে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের মাঠে একটি বৈঠক ডাকেন সিপাহী মইনুদ্দিন। কয়েকজনকে নিয়ে করা ওই বৈঠকে দরবারের দিন সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করার জন্য রশি আর চাকু নিয়ে প্রস্তুত থাকার গোপন ছক করা হয় বলে নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
গত রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিশন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্র“য়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনার পর হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনে করা মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। এছাড়া আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ২৪শে ডিসেম্বর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা পুনঃতদন্তের জন্য জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্র্বতী সরকার। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত রোববার প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।
১৪নং কয়েদি সাক্ষীর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যায় সিপাহী মইনুদ্দিন ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের মাঠে একটি বৈঠক ডাকেন। সেখানে সিপাহী সেলিম ও মইনুদ্দিনসহ আরো ১০-১২ জন ছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে সবাই দরবারের দিন রশি আর চাকু নিয়ে প্রস্তুত থাকবে জিম্মি করার জন্য। যেহেতু তারা সেনা অফিসার তারা তো আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে। তাই সবার সঙ্গে চাকু রাখার পরিকল্পনা হয়। সেদিন রাতেই লেঃ কর্নেল শামস সাহেব সিপাহী সেলিম এবং মইনুদ্দিনকে ডাকে। সেখানে তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আগামীকাল কোয়ার্টার গার্ডে ডিউটিতে থাকবে মেজর রিয়াজ। তোমরা সেখানে গেলে সে তোমাদের অস্ত্র দিয়ে দেবে।’
৬৫ নাম্বার সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, সেন্ট্রাল কোয়ার্টার গার্ডে তিনটি ব্যাটালিয়নের (২৪, ৪৪ এবং সদর ব্যাটালিয়ন) এর অস্ত্র রক্ষিত ছিল। ঘটনার পূর্বে ২১ ফেব্র“য়ারি থেকেই অফিসাররা কোয়ার্টার গার্ডে ডিউটি দিয়ে আসছিলেন। এই ডিউটি দেওয়ার বিষয়ে মেজর রিয়াজ জিএসও-২ (আই) মেজর মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করলে মেজর রিয়াজকে তিনি জানান যে উড়ো চিঠি আছে, তাই বাড়তি সতর্কতা। এর বেশি কিছু তিনি জানাননি।
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারি রাতে ডিজির বাসভবনে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হক ডিজিকে ২৫ ফেব্র“য়ারি ৮টায় নির্ধারিত দরবারের সময়সূচি পরিবর্তন করে ৯টায় করার জন্য অনুরোধ জানান। পরে বিষয়টি নিয়ে ডিওটি কর্নেল আনিসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে দরবারের সময়সূচি পরিবর্তনের আদেশ দেন ডিজি। (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-১১২)।
ঘটনার আগে পিলখানায় ‘কমান্ড এনভায়রনমেন্ট’ : ৪৫ নাম্বার সাক্ষীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, পিলখানার কমান্ড এনভায়রনমেন্টে কাঠামোগত সমস্যা ছিল। অফিসার সৈনিকদের গ্যাপ বেড়ে গিয়েছিল। অফিসার এবং তাদের পরিবারের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। ইনফ্যান্ট্রি ছাড়া অন্যান্য আর্মস এবং সার্ভিসের অফিসারদের আধিক্য অফিসার-জওয়ান সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছিল।
দরবার হল ভাড়া দেওয়ার সময় কিছুটা স্বজনপ্রীতি ছিল। ওপেন টেন্ডার নীতিমালা অনুসৃত হয় নাই। বাবুল নামে ডিজির পরিচিত ব্যক্তিকে পুনঃ পুনঃ উক্ত লিজ দেওয়া হয়।
ডিজির জিএসও-২ (কর্ড) মেজর মাহবুবের বিদেশ ভ্রমণের একটি প্রস্তাবে সেনাসদর ছাড়পত্র দেয়নি। বিষয়টি কর্নেল অ্যাডমিন ডিজিকে জানালে তিনি সরাসরি সেনাসদরে কথা বলে ছাড়পত্র আনার ব্যবস্থা করেন। মেজর মাহবুরের সঙ্গে ডিজি ও তার স্ত্রীর দৃষ্টিকটু সম্পর্ক ছিল। মেজর মাহবুব সাধারণত ডিজির বাসাতেই অবস্থান করতেন।
অফিসারের স্বল্পতার জন্য প্রশাসন ব্যাহত হলেও কখনো অকার্যকর ছিল না। সহানুভূতিসূচক পোস্টিংয়ের জন্য অফিসারদের, বিশেষত ঢাকা সেক্টর অফিসারদের, কাজের প্রতি অমনোযোগিতা দেখা যেত। অফিসাররা সাধারণত সৈনিক কেন্দ্রিক ছিল না।
‘অপারেশন ডাল-ভাত’ ও কঠোর শৃঙ্খলায় সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ : ১১৭ নাম্বার সাক্ষীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ শুরু হওয়ার পরে প্রথম এক দেড়মাস পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হলেও দিন দিন সৈনিকদের মধ্যে তা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা অপারেশন ডাল-ভাতে নিদারুণ কষ্টের ভেতর দিন অতিক্রম করতো। প্রায়ই ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্তৃক ডকুমেন্টারি শাস্তি দেওয়া হতো। ডাল-ভাতের স্টলগুলোতে প্রথমদিকে জাল টাকা এবং পরিমাপের ঘাটতি মওকুফ করা হলেও একপর্যায়ে স্টলগুলোয় নিয়োজিত সৈনিকদের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়।
জরুরি প্রয়োজনেও সৈনিকরা ছুটি পেত না। ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। সেনা কর্মকর্তা হিসাবে বিডিআরে এসে সেনাবাহিনীর মতো প্রশিক্ষণকে কঠিন করে ফেলেছিলেন। ইউএন মিশনের জন্য বিডিআর সৈনিক নির্বাচনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী বেশ কিছু নিয়মনীতি আরোপ করেছিলেন, যার ফলে অনেকই মিশনে যাওয়ার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়েন। এ বিষয়টি অনেকের মাঝে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।
একই সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, জুনিয়র অফিসার, অফিসারদের স্ত্রী এবং বিভিন্ন পদবির সৈনিকগণ ডিজি বিডিআর মেজর জেনারেল শাকিলের স্ত্রীকে ভয় পেতেন। বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল যখন ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক ছিলেন তখন মেজর মাহবুব তার এ্যাডজুটেন্ট ছিলেন। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল শাকিল যেখানেই বদলি যেতেন সেখানেই মেজর মাহবুবকে বদলি করে নিয়ে যেতেন। এভাবে তিনি সামরিক সচিব হিসেবে তার নিজের কাছে এবং পরবর্তীতে বিডিআরএ প্রেষণে যাওয়ার পরে মেজর মাহবুবকেও প্রেষণে বিডিআরএ নিয়ে আসেন এবং তার জিএসও-২ (কর্ড) হিসেবে বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পূর্ব পর্যন্ত নিয়োজিত রেখেছিলেন। মেজর মাহবুবও পিলখানায় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মেজর মাহবুব উচ্চপদস্থ অফিসারদেরও রীতিমত অবজ্ঞা করতে দ্বিধা করতেন না।
২৬ নাম্বার সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সিজিএস হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন ডিজি বিডিআর মেজর জেনারেল শাকিল সম্বন্ধে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রতিবেদন পান। বিষয়টি তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

্রিন্ট

আরও সংবদ