খুলনা | রবিবার | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৬ পৌষ ১৪৩২

অকুতোভয় জুলাই যোদ্ধা হাদির বীরোচিত বিদায়, চিরনিদ্রায় বিদ্রোহী কবির পাশে

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৭ এ.এম | ২১ ডিসেম্বর ২০২৫


অকুতোভয় জুলাই যোদ্ধা ও আধিপত্যবাদ বিরোধী শহীদ শরীফ ওসমান বিন হাদি। এখন হাদি কেবল একটি নাম নয়, বিদ্রোহী এক কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের প্রতীক। শত হুমকি ও শত্র“র ভয় তাকে কখনও দমাতে পারেনি। দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বলতেন, ‘বুলেট ছাড়া কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।’ শেষ পর্যন্ত সেই বুলেটই তার মস্তিষ্ক ভেদ করে ঝরিয়েছে রক্ত, বাংলাদেশের বুকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার, সেখান থেকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর এই পুরো পথে তার সঙ্গে ছিল কোটি মানুষের ভালোবাসা ও প্রার্থনা। তবে বীরের পথও একসময় শেষ হয়, যখন মহান আল্লাহর ডাক আসে।
হাদি নিজেও শহীদি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়ে শহীদি মৃত্যুতে যদি নতুন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে, তাহলে আগামী এক হাজার বছর বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য নামাজে দোয়া করবে।’
দেশের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় প্রিয় ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সম্মুখসারির যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরীফ ওসমান হাদি। কোটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নিলেন তিনি। নিকট অতীতে এতটা ভালোবাসা নিয়ে চিরবিদায় নিতে আর কাউকে দেখা যায়নি। হাদির চলে যাওয়া ছুঁয়ে গেছে গোটা জাতিকে।
শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে সমাহিত করা হয় শহীদ ওসমান হাদিকে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন ওসমান হাদি। সেই বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করে ঝড় তুলতেন ময়দানে। অবশেষে নজরুলের পাশেই শায়িত হলেন জাতীয় বীর শরিফ ওসমান বিন হাদি।
হাদিকে দাফন করার সময় পরিবারের সদস্য, রাজপথের সহযোদ্ধাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় জনসমাগম হওয়ার সুযোগ ছিল না। যদিও লাখ লাখ জনতা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে হাদিকে শেষ বিদায় জানান।
এদিকে হাদির শেষ বিদায়কে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শাহবাগ ও মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে জনতার ঢল নামে। তারা শেষবারের মতো এই বিপ্লবীকে বিদায় জানাতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেন।
এর আগে দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করেন তার বড় ভাই মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক।
এতে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাঃ শফিকুর রহমান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, অন্তর্র্বতী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনতা। এছাড়াও ছিলেন শরিফ ওসমান হাদির পরিবারের সদস্য এবং তার সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যরা।  লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা।
জানাজার আগে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হাদির ভাই আবু বকর সিদ্দিক। আবু বকর সিদ্দিক তার বক্তব্যে হাদির স্মৃতিচারণ এবং তার জন্য দোয়া কামনা করেন।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর) থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে তিনি ‘চা-শিঙাড়া আড্ডা’র মতো ব্যতিক্রমী কর্মসূচির আয়োজন করে আলোচনায় আসেন। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতার সমালোচনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তিনি। পুরোনো ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচক হাদির মতে, সেই ধারায় ক্ষমতায় এলে কেউ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না।
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার রাতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমবেত হন। এ সময় তারা ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘আমরা সবাই হাদিই হবো, যুগে যুগে লড়ে যাবো’, ‘এক হাদি লোকান্তরে, লক্ষ হাদি লড়াই করে’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’, ‘ওই হাসিনা দেইখা যা, রাজপথে তোর বাপেরা’, এমন নানা স্লোগান দেন।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাসখানেক আগে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। তিনি গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোনকল করে এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ ক্যাডাররা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্তে¡ও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না তিনি।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসীর গুলিতে মারাত্মক আহত হন ওসমান হাদি। রিকশায় থাকা অবস্থায় তার মাথায় গুলি লাগে। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে অবস্থার অবনতি হলে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলে সেখানে ১৮ ডিসেম্বর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে মারা যান তিনি।
শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয় ওসমান হাদির মরদেহ। সেখান থেকে সরাসরি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয় লাশ।
আজ সেখান থেকে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ নেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় সংসদ সংলগ্ন মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে। জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই সমাহিত হলেন বিপ্লবী এই তরুণ।
রাষ্ট্রীয় শোক : হাদির মৃত্যুতে শনিবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয় বাংলাদেশে।  দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে অর্ধনমিত ছিল জাতীয় পতাকা। একই সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্তও কার্যকর করা হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : শরীফ ওসমান হাদি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মাদরাসা শিক্ষক ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবনের সূচনা। পরে ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন-প্রথমে একটি ইংরেজি শেখার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এবং সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস-এ। এই শিক্ষাগত পটভূমি ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাই তার রাজনৈতিক দর্শনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ওসমান হাদি পরে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গড়ে তুলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। তার যুক্তিতর্কের অনেক ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন। রামপুরা এলাকায় স্থানীয় সংগঠক ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি ছাত্র-জনতার মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এই অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক ধারার অন্যতম তরুণ স্থপতি হিসেবে ওসমান হাদির নাম উচ্চারিত হতে থাকে।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সংগঠক, সমালোচক ও পরিবর্তনের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন,যার পরিণতি হলো ইতিহাসের পাতায় শহীদ জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তার নাম অমর হয়ে যাওয়া।

্রিন্ট

আরও সংবদ