খুলনা | শনিবার | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১২ পৌষ ১৪৩২

পাটকেলঘাটায় ডাক্তারদের উচ্চ কমিশনে অপ্রয়োজনীয় ঔষধ কিনছে রোগীরা

এস.এম মজনু, পাটকেলঘাটা (সাতক্ষীরা) |
১১:৫৫ পি.এম | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫


নিন্মমানের কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চমানের উপঢৌকন নিয়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ২৩১ জন চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখছেন বলে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৬ জন এমবিবিএস আর বাকী সবাই পল­ী ডাক্তার নামে পরিচিত।  যে কোম্পানির কাছ থেকে ডাক্তাররা যত বেশি টাকা পাচ্ছেন সে কোম্পানির ততো বেশি ওষুধ লিখছেন। উপহার না দিলে অতি প্রয়োজনীয় টপটেন কোম্পানির ওষুধও তারা লেখেন না। এভাবে গরিব অসহায় রুগীদের জিম্মি করে তাদের নিম্নমানের ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক পল­ী ডাক্তারের বিরুদ্ধে বাবস্থাপত্রে হরহামেশাই এন্টিবায়োটিক লেখারও অভিযোগ রয়েছে। যা রেজিস্টার্ড ডাক্তার ছাড়া লিখতে পারেন না।
সূত্র জানায় সবচেয়ে বেশি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ গুলোর মধ্যে রয়েছে, এন্টিবায়োটিক, সিডেটিভ, অ্যান্টিডায়ারিয়াল, ভিটামিন, টনিক, কফমিকচার, স্টেরয়েড, অ্যান্টিহিস্টামিন।
অ্যান্টাসিড জাতীয় ওষুধ ও টনিক ভিটামিনের প্রতি এলাকার মানুষের অকৃত্রিম দুর্বলতা রয়েছে। এ দুর্বলতার কারণ হিসেবে জানা যায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ড্রাগ প্রমোশন এবং চিকিৎসক কর্তৃক এসব ওষুধের ঢালাও প্রয়োগ। টনিক ও ভিটামিন সম্পর্কে কোম্পানিগুলো যেসব ভ্রান্ত ধারণা চিকিৎসক ও জনসমক্ষে তুলে ধরে তার মধ্যে রয়েছে টনিক ও ভিটামিন সেবনে ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধার, বয়স্কদের যৌবন প্রাপ্তি, শিশুদের মেধা ও বয়ঃবৃদ্ধি, ত্বকের শ্রীবৃদ্ধি ও চুলপড়া বন্ধ হওয়া। তাদের এসব বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকা সত্তে¡ও বহু চিকিৎসক প্রায়ই এসব প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকেন। রোগী প্রয়োজনীয় মনে করে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে এসব ওষুধ কিনছেন। ফলে এসব ওষুধের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের কোনটি প্রয়োজনীয়, কোনটি অপ্রয়োজনীয় অথবা প্রদত্ত ওষুধের সঙ্গে সৃষ্ট রোগের আদৌ সম্পর্ক রয়েছে কি না এসব প্রশ্ন উপস্থাপন করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রোগীরা সচরাচর রাখে না। ফলে রোগী প্রেসক্রিপশন মোতাবেক ওষুধ কিনে গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এতে রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া অপ্রাসঙ্গিক বা ক্ষতিকর ওষুধ খেলে রোগী মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া বা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। এ ক্ষতির দায়দায়িত্ব আবার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নিতে চান না।
স¤প্রতি উপজেলার পাটকেলঘাটা বাজারে এক ডাক্তারের চেম্বারে যেয়ে দেখা যায়, সেখানে রোগীর চেয়েও ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভিড় বেশি। তারা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপাটিপি করছে। কোনো রোগী প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হলেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ছবি তুলছে। এতে অধিকাংশ রোগী বিরক্ত হচ্ছে। তবে ছবি তোলার কারণ হিসেবে জানা যায়, ডাক্তার তার কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন কিনা সেটা বোঝার জন্য ছবি নিচ্ছেন। এই ব্যাবস্থাপত্রের ছবি তারা আবার তৎক্ষণাৎ তাদের উপরের অর্থাৎ বিভাগীয় কর্মকর্তার কাছে পাঠাচ্ছেন। একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ কে দিনে ১০০ প্রেসক্রিপশন পাঠাতে হয়। যেগুলোতে তার কোম্পানির ওষুধ লেখা থাকবে। অনেকে টার্গেট পূরণ করতে নিজেরাও নকল প্রেসক্রিপশন করে উপরে পাঠান চাকরি বাঁচানোর জন্য।
জানা যায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো টাকার লেনদেন গোপনে করলেও নতুন কোম্পানিগুলো কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই এখন লেনদেন করছে। এর মাধ্যমে ওই সব কোম্পানির মানহীন ওষুধ বেশি বেশি লিখছেন সংশ্লিষ্ট ন্যায়নীতি বিবর্জিত বিবেকহীন ডাক্তাররা। একই কারণে এখন ৮-১০ রকমের ওষুধ প্রেসক্রাইভ করছেন তারা। ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে উপহার হিসেবে নেওয়া ঘরের ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপ সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র।
কয়েকজন চিকিৎসকের কমিশন বানিজ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, আমরা সব হাসপাতাল ক্লিনিক ও পল­ী ডাক্তারদের একটা তালিকা তৈরি করি। তাদের নানা উপায়ে বিভিন্ন দামী উপহার এমনকি ঘর সাজানোর সামগ্রী বাসায় দিয়ে আসি। তারপর ডাক্তারদের সঙ্গে একধরনের মৌখিক চুক্তি করি। তারা প্রেসক্রিপশনে আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখবে। তার বিনিময়ে ডাক্তারা মাসিক কমিশন ও দামী উপহার পাবেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডাক্তার বলেন, অনেক ডাক্তার আর্থিক সুবিধা ও স্পন্সর সুবিধা নিয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভদের নির্ধারিত ওষুধ লিখে থাকে। এতে অনেক সময় নিম্নমানের ওষুধ লিখতে বাধ্য হতে হয়। এসব কারণে অনেক রোগী আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমান ডাক্তাররা রোগীদের জন্য না, তারা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের জন্য। তারা নিজেরাই ভুগছেন কমিশন রোগে। তাহলে প্রকৃত রোগীদের তারা কেমন করে সঠিক সেবা দেবে। তারা নিরীহ রোগীদের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। 

্রিন্ট

আরও সংবদ