খুলনা | রবিবার | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৩ পৌষ ১৪৩২

নারী, শিশুসহ আহত ৪, তিন নারী গ্রেফতার

কেরানীগঞ্জে বিস্ফোরণে উড়ে গেল মাদ্রাসার কক্ষ, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

খবর প্রতিবেদন |
০১:৪৯ এ.এম | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫


ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।
বিস্ফোরণে মাদ্রাসার একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দু’টি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের ভাষ্য। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মূল সন্দেহভাজন শেখ আলামিন পলাতক রয়েছেন।
শনিবার বিকেলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান।
উলে­খ্য, শুক্রবার (সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার একতলা ভবনে এ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্তত চারজন আহত হন। এ ঘটনায় মাদ্রাসার পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল­াহ (৭) আহত হন।  এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, “বিস্ফোরণের পরপরই এন্টি টেরোরিজম ইউনিটকে অবহিত করা হয়। পাশাপাশি সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলকে ক্রাইম সিন হিসেবে চিহ্নিত করে।”
তিনি জানান, ঘটনাস্থলে তল­াশি চালিয়ে একটি ল্যাপটপ, দু’টি মনিটর, বিভিন্ন ধরনের লিকুইড রাসায়নিক এবং চারটি ককটেল সদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে মাদ্রাসাটি শেখ আলামিন ও তার স্ত্রী আসিয়া পরিচালনা করছিলেন। ভবনের চারটি কক্ষের মধ্যে দু’টি মাদ্রাসার কাজে ব্যবহৃত হতো এবং বাকি দু’টি কক্ষে তারা পরিবারসহ থাকতেন। বিস্ফোরণের সময় আসিয়া ও তাদের তিন সন্তান ভবনে ছিলেন। আহতদের মধ্যে আছেন আসিয়া এবং তার তিন সন্তান।
পুলিশ সুপার বলেন, “বিস্ফোরণের পর আলামিন তার স্ত্রী ও সন্তানদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। তবে সেখানে স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ঘটনার পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একাধিক টিম অভিযান শুরু করে। ঢাকা জেলা ডিবির টিমও অভিযানে যুক্ত ছিল।”
পুলিশ জানায়, আলামিনের স্ত্রী আসিয়া ও তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে শুক্রবার দিবাগত রাতে ঢাকার বাসাবো এলাকা থেকে আসমানি খাতুন নামে আরেক নারীকে আটক করা হয়। পরে তাদের তিনজনকেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
আলামিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, শেখ আলামিনের নামে ঢাকার আশপাশের কয়েকটি জেলায় মামলা রয়েছে। তিনি ২০১৭ ও ২০২০ সালেও গ্রেফতার হন। এছাড়া আসমানি খাতুন ওরফে আসমার নামেও দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।”
তিনি জানান, ২০২৩ সালে জামিনে মুক্তির পর আলামিন প্রথমে অটোরিকশা ও পরে উবার চালক হিসেবে কাজ করতেন।
পুলিশ সুপার বলেন, “ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে, তবে এখনও লিখিত মতামত দেয়নি। ঘটনাস্থলে ব্যাপক রাসায়নিক মজুদ এবং ককটেল সদৃশ বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ও এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের প্রাথমিক ধারণা, রাসায়নিক বিক্রিয়া অথবা বিস্ফোরকজাত দ্রব্যের কোনো প্রতিক্রিয়ার কারণেই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে।
পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থলে বিভিন্ন কন্টেইনারে আনুমানিক ৪০০ লিটার লিকুইড রাসায়নিক পাওয়া গেছে। কিছু কন্টেইনারে ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড’ লেখা ছিল। ধ্বংসস্তূপের কারণে এখনও পুরো সিজার লিস্ট চূড়ান্ত করা যায়নি।
জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। ঘটনাস্থলে হ্যান্ডকাফ, “পুরোনো বেল্টসহ কিছু সন্দেহজনক সামগ্রী পাওয়া গেছে, সেগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে।”
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নাশকতার কোনও পরিকল্পনা ছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত বলার মতো কিছু নেই।”
পুলিশের তথ্যমতে, মুফতি হারুন নামে একজন ব্যক্তি মাদ্রাসার অন্যতম পরিচালক ছিলেন, তিনিই বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, “প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে, তারা বিস্ফোরকজাত দ্রব্য নিয়ে কিছু করছিলেন। তবে এখনই এটিকে নাশকতা বলা যাচ্ছে না। মামলা দায়েরের পর বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট, রাসায়নিকের উৎস, প্রশিক্ষণ বা ডায়াগ্রামের কোনো আলামত আছে কি না-সবকিছু খতিয়ে দেখা হবে।” তিনি বলেন, “দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রাজধানীর একেবারে কাছে ও জনবহুল এলাকা। সৌভাগ্যক্রমে সময় ও দিনের কারণে বড় ধরনের প্রাণহানি হয়নি।”
নাগরিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আশপাশে ভাড়াটিয়া বা সন্দেহজনক কোনও কর্মকাণ্ড নজরে এলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে।”
বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের মধ্যে আলামিনের বড় ছেলে উম্মায়ের তুলনামূলকভাবে বেশি আহত হলেও কারও বড় ধরনের বার্ন ইনজুরি নেই। অধিকাংশ আঘাত ধ্বংসাবশেষ ধসে পড়ার কারণে হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসনাবাদ এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। তখন দৌড়ে গিয়ে দেখি, মাদ্রাসার পশ্চিম পাশের দু’টি কক্ষের চারপাশের দেয়াল উড়ে গেছে। বিস্ফোরণে একতলা ভবনের দু’টি কক্ষের দেয়াল সম্পূর্ণ ধসে পড়ে এবং ছাদ ও বিমে ফাটল দেখা দেয়। পাশের আরও দু’টি কক্ষেও ফাটল ধরেছে।’
ওই বাসিন্দা আরও বলেন, মাদ্রাসাটিতে ৩০ থেকে ৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
ভবনের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন পরিবারসহ তিন বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন।
পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’
ভবন মালিক পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আলামিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝে মধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে। পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।’

্রিন্ট

আরও সংবদ