খুলনা | বুধবার | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৬ পৌষ ১৪৩২

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামীর পাশে দাফন আজ বিকেল সাড়ে তিনটায়

মহাকালের সমাপ্তি

খবর ডেস্ক |
০১:০৪ এ.এম | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫


হাসপাতালে ৩৭ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে হার মানলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম নারী এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হয় (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আমরাতো আল্লাহর এবং আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। আপসহীন নেত্রী বিদায় জানালেন দেশবাসীকে। গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়াকে। এরপর থেকে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামীর পাশে আজ বিকেল সাড়ে তিনটায় : সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জানাজা বুধবার বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দুপুর ২টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে তিনটায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে চন্দ্রিমা উদ্যানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে।  প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং মঙ্গলবার দুপুরে এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক দাফন সম্পন্ন হবে। এতে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। জানাজায় কোনো ব্যাগ বা ভারী সামগ্রী বহন করা যাবে না।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডাঃ জিয়াউল হক জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তিনি অনেকটা লাইফ সাপোর্টে আছেন।’ রাতে অবস্থার অবনতি হলে তাঁর বড় ছেলে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যারা হাসপাতালে যান। রাত ২টার পর এজেডএম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া ‘অত্যন্ত সঙ্কটময়’ সময় অতিক্রম করছেন। উনার পরিবারের পক্ষ থেকে উনার সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দেশবাসীকে দোয়া করার আহবান জানাচ্ছি। এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসনকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় হাসপাতালে ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, প্রয়াত সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদা জিয়ার মেজ বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসা তদারকি করেন। এই মাসের শুরুতে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরবর্তীতে তা সম্ভব হয়নি।
শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ২৩ নভেম্বর জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। এর আগে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রওনা দিয়ে গাড়িতে ওঠেই অস্বস্তি বোধ করছিলেন তিনি। 
কয়েক বছর ধরে নানান ধরনের গুরুতর রোগে ভুগছিলেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অনেক বছর ধরেই খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস এবং চোখের সমস্যাসহ নানান জটিলতায় ভুগছিলেন। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন সবশেষ জানান, ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।
২০১৮ সালের ফেব্র“য়ারি থেকে পরের দুই বছর দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে একাকী সময় কাটান। সে সময় কারাগারে নিলে তার স্বজনরা সাক্ষাৎ করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘খালেদা জিয়া অসুস্থ।’ কারাগারে থাকাকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়াকে কয়েকবার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। যদি দেশে সে সময় তার পছন্দ ছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল। বারবার আবেদনেও আওয়ামী লীগ সরকার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়নি। তাকে বিদেশে নিতে আন্দোলন-বিক্ষোভও করেন তার দলের নেতাকর্মীরা।
দেশের রাজনীতিতে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত এই বরেণ্য রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে জাতি এক অভিভাবককে হারালো। তাঁর মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নারী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পেয়েছিলেন। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে জীবনের পরম সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন থাকে। মামলা- মোকদ্দমা, গ্রেফতার, কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ এসবও তাঁদের জীবনে অভাবনীয় নয়। খালেদা জিয়াও চরম পর্যায়ের এমন নির্যাতন সহ্য করেছেন। সহ্য করেছেন স্বামী–সন্তান হারানোর গভীর শোকসন্তাপ, আর দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা।
রাজনৈতিক জীবনে মতাদর্শিক দ্ব›দ্ব-সংঘাত ছাড়াও প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত, তারপর থেকে প্রথমে কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় ও পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। দুর্নীতির আরেকটি মামলাতেও তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই নির্বাহী আদেশে বিশেষ শর্তে মুক্তির পর তিনি গুলশানের বাসায় উঠেন। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় নিজের বাসায় বন্দি থাকা অবস্থায় করোনা আক্রান্তও হন খালেদা জিয়া। শ্বাসকষ্টে ভোগার কারণে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তখনও তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন, যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল।
এরপর ২০২৪ সালের জুনে তাঁর হৃদপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়। তখনও তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন, যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল।
এর আগে থেকেই তাঁর হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। আগে একটা রিংও পরানো হয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের জুনে পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার লিভারের চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছে বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে।
২০২৪ সালের জুনে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বৈঠকে তার শরীরে পেসমেকার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেময় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডামের হৃদরোগের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। হার্টে ব্লক ছিল। আগে একটা রিং পরানো হয়েছিল। সবকিছু পর্যালোচনা করে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে পেসমেকার বসানো হয়।’
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে সব দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। এরপর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান তিনি। পরে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ম্যাডামের নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে, যা আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। সর্বোপরি ওনার লিভারের জটিলতা অর্থাৎ লিভার সিরোসিস পরে কম্পেনসেন্টারি লিভার ডিজিজ বলে গ্রেট-টু সেটার জন্য টিপস (চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ পদ্ধতি টিআইপিস-টিপস) করা হয়েছে। টিপসের কিছু টেকনিক্যাল অ্যাসপেক্ট আছে অ্যাডজাস্টমেন্টের বিষয় আছেৃ আপনি দেখতে হার্টে স্টান্টিং করার পর চেক করে আবার সেটার জন্য রি-স্টান্টিং করে অথবা চেক করে দেখে যে, স্টান্টিংটা ভালোভাবে কাজ করছে কি না-এই জিনিসগুলো তো আমরা করতে পারি নাই।’
প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তীব্র নেতৃত্ব সংকটে পড়ে বিএনপি। ঠিক সেই সময় কখনও রাজনীতিতে না আসা খালেদা জিয়া দলটিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি সহ-সভাপতি হন। একই বছরের ১০ মে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে তিনি পুনরায় চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরশাদ সরকার তাঁর চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং বহুবার আটক করে। তবুও খালেদা জিয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান, হয়ে ওঠেন ‘আপসহীন নেত্রী’।

্রিন্ট

আরও সংবদ