খুলনা | রবিবার | ১৩ জুলাই ২০২৫ | ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

বাই বাই পরীক্ষা আতঙ্ক

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০১:০৫ এ.এম | ১৩ নভেম্বর ২০২১


কেস স্ট্যাডি-(১) সাদমান, বয়স-১৪ বছর। বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় ভয় ক্লাসের পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ। পরীক্ষা যখন সামনে সমাগত হয়, তখন সে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভাল স্ট্যাডি থাকা সত্তে¡ও পরীক্ষা সামনে এলে সে প্রায় মনে করে যে, তার ফেল করার সম্ভাবনা খুব বেশি। তার ভিতর আরো মনে করার প্রবনতা তৈরি হয় যে, সব কিছু জানা সত্তে¡ও পরীক্ষার কক্ষে সঠিক ভাবে লিখে আসতে ব্যর্থ হবে।
কেস স্ট্যাডি-(২) প্রিয়াঙ্কা, বয়স-১৬ বছর। পড়াশোনায় বেশ আন্তরিক ও খুব সিরিয়াস। কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায়। পড়াশোনা সংক্রান্ত কোন পরীক্ষা এলে তার উদ্বিগ্নতার মাত্রা খুব বেড়ে যায়। পরীক্ষার কয়েক দিন পূর্ব হতে সে ঠিক মত আর টেবিলে পড়তে বসতে পারে না। পরীক্ষার পূর্বে তার খাওয়া দাওয়া কমে যায়। মেজাজ খিট খিটে হয়ে যায়। কারোর সাথে কথা বলতে চায় না, মানুষের সাথে এমন কি পরিবারের লোকদের সাথে মেলা মেশা কমিয়ে দেয়।
উপরের দু’টি ঘটনা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি সংক্রান্ত বিষয়কে নির্দেশ করে। ছাত্র জীবনে যে বিষয়টি বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সব চেয়ে বেশি ভয় পায়; তা হলো ‘পরীক্ষা’। পরীক্ষা মানেই একটু বাড়তি চাপ, যার প্রভাব সবার নিকট সমান ভাবে বিরাজমান নয়। শিশুর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, পিতা-মাতার সাথে সন্তানের আবেগীয় উষ্ণ সম্পর্ক, শিশুর উপর পরিবেশে ও প্রতিবেশের মনোসামাজিক প্রভাব ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক সক্ষমতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এরূপ চাপ সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হলো পরীক্ষার ভীতি।
পরীক্ষার ভীতির শারীরবৃত্তিয় কারণ : শিক্ষার্থী মাত্রই পরীক্ষার সময় স্বাভাবিক ভাবে এক প্রকার মানসিক চাপ অনুভব করে। এই মানসিক চাপ বেশি মাত্রায় অনুভূত হলে ‘হাইপোথ্যালামাস’, ‘পিটুইটারি গ্রন্থি’ এবং ‘এড্রেনাল কর্টেক্স’ -এই সংগঠনটি একত্রে অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠে। ফলে ব্যক্তি বেশি মাত্রায় আবেগীয় অবস্থা অনুভব করে। আবার ব্যক্তি যখন অতি মাত্রায় মানসিক চাপ বোধ করে, তখন ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে বেশি মাত্রায় ‘কর্টিসোল’ নামক হরমোন ক্ষরণ হয়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে এক প্রকার ভীতি পরিলক্ষিত হয়।
পরীক্ষার ভীতির মনস্তাত্তি¡ক ও অন্যান্য কারণ : (!) পরিবেশগত কারণ : (১) পিতা-মাতার কর্তৃক সন্তানের ফলাফল সংক্রান্ত উচ্চ আশা। (২) পিতা-মাতা যখন সন্তানের উপর অত্যধিক প্রত্যাশা প্রয়োগ করেন। (৩) পিতা-মাতা যখন সন্তানের পরীক্ষার ফলাফলকে সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেন। (৪) পিতা-মাতা যখন প্রায় সময় সন্তানকে অন্য শিক্ষার্থীর সাথে তুলনা করে থাকেন। (৫) ফলাফল সংক্রান্ত শিক্ষকের বিরূপ সন্তব্য বা শিক্ষক সংক্রান্ত অন্য কোন সমস্যা।
(!!) পাঠ সংক্রান্ত সমস্যা : (১) অনিয়মিত পড়া, (২) পরীক্ষার পূর্বে সারা রাত্র পড়া, (৩) ট্রপিক্স এর অর্থ না বুঝে মুখস্ত করা, (৪) সঠিক ভাবে রিভাইস না দেওয়া, (৫) পড়ার বিষয় মনে করতে ব্যর্থ হওয়া, (৬) রিভাইজিং নোট তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়া।
মনোস্তাত্তি¡ক কারণ : (১) পরীক্ষা সংক্রান্ত নেতিবাচক চিন্তা, (২) পরীক্ষা সংক্রান্ত আত্মবিশ^াসের অভাব, (৩) পরীক্ষা ও ফলাফল সংক্রান্ত অযৌত্তিক চিন্তা, (৪) যদি ফেল করি, তবে মান সম্মান নষ্ট হবে- এরূপ অযৌক্তিক চিন্তা, (৫) ১০০% সঠিক ফলাফল প্রাপ্তির আশা নতুবা আমি মূল্যহীন হয়ে পড়বো- এরূপ অযাচিত চিন্তা।
অন্যান্য কারণ :
# জনতার ভীতি : অনেক শিশু বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝে কথা বলতে, বসতে এমন কি লিখতে ভয় পায়।
# বংশগত কারণ : যদি পূর্বে পিতা-মাতার এরূপ ভীতি থেকে থাকে তবে তাহা তার সন্তানদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।
# স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের গঠন : মানুষের স্নায়ুন্ত্রের মধ্যে দৃঢ়তা ও নমনীয়তার দিক দিয়ে পার্থক্য বিদ্যমান। যাদের স্নায়ুতন্ত্র গাঠনিক কার্যক্রম নমনীয় তাদের একই সময়ে বহু সংখ্যক উদ্দীপক দ্বারা সহজে উদ্দীপিত হয়। যেহেতু পরীক্ষার কক্ষে শিশুর সামনে একই সময়ে বহু সংখ্যক উদ্দীপক উপস্থিত হয়, সেহেতু যাদের মস্তিষ্ক গঠন নমনীয় তারা পরীক্ষা কক্ষে অনেক গুলো উদ্দীপক দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয় এবং ভীতি অনুভব করে।
শারীরিক প্রকাশ : (১) পরীক্ষার পূর্বে শিশুর বুক ধরফর করতে পারে, (২) পরীক্ষার টেনশসনে শিশুর খাবারে অরুচি দেখা দিতে পারে, (৩) শিশুর মধ্যে অনিদ্রা দেখা দিতে পারে, (৪) ক্ষেত্র বিশেষ বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে, (৫) পরীক্ষার সময়ে প্রচুর ঘামতে পারে, (৬) পরীক্ষার ভয়ে মুখ কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠতে পারে, (৭) পরীক্ষার ভয়ে শ^াস-প্রশ^াস ছোট হয়ে যেতে পারে।
পরীক্ষর ভীতি দূর করতে মা-বাবার করণীয় : (১) বাসায় পড়ার পরিবেশ তৈরী করুন : পরীক্ষার সময় শিশুকে একটি কোলাহলমুক্ত পরিবেশ উপহার দেবার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে শিশুটির পড়ার মনোযোগ বিধানে সহায়ত করবে। (২) শিশুকে ভাল ভাবে লক্ষ্য করুন : শিশুটি পরীক্ষা ভীতিতে আক্রান্ত কিনা তাহা বোঝার জন্য তাকে ভাল ভাবে লক্ষ্য করুন। পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, খাওয়ার অরুচি, ঘুম না আসা, মন ভাল না থাকা, পড়া ভুলে যাওয়া ইত্যাদি বলে দেবে শিশুটি পরীক্ষার ভীতিতে আক্রান্ত। (৩) শিশুর মনে ইতিবাচক মনোভাব তৈরীতে সহায়তা করুন : ‘তুমি পারবে’- এমন একটি উক্তি শিশুর মনোবল তৈরীতে যথেষ্ট সহায়ক। যা পরীক্ষার ভীতিকে দূর করতে যথেষ্ট সহায়ক। (৪) শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন : শিশুর ঘুমের ঘাটতি তার মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার একটি অন্যতম কারণ। সুতরাং প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ হতে ৮ ঘন্টা শিশুর ঘুমের ব্যবস্থা করুন। এতে তার মন শান্ত থাকবে। (৫) পড়ার মাঝে শিশুটিকে বিরতি দিন : শিশুটিকে পড়ার মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে তার সাথে গল্প করুন কিংবা মাঝে মাঝে প্রিয় কার্টুন দেখতে দিন। এতে তার মানসিক চাপ কমবে।
পরীক্ষার্থী কর্তৃক অনুস্মরণীয় : (১) সময়মত রিভাইস দিতে হবে। (২) পরীক্ষার পূর্বে হালকা খাবার খেতে হবে। (৩) রুটিন অনুযায়ী পড়তে হবে। (৪) পড়ার মধ্যে মাঝে মাঝে বিরতি রাখতে হবে। (৫) পরীক্ষার দিন পূর্বে কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। (৬) পরীক্ষার পূর্বের দিন সব কিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। (৭) পরীক্ষার ভীতি সংক্রান্ত বিষয়কে পরিবারের সদস্যদের সাথে বা বন্ধুদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। (৮) পরীক্ষার পূর্বে রিভাইজ করার সময় মেইন পযেন্ট, সাব পয়েন্ট, দিন, তারিখ বা বিশেষ বিষয় লিখে রাখা যেতে পারে। তাতে মিমোরাইজ ভাল হবে। (৯) পরীক্ষার সময়ে অন্যের কোন বিষয়ে নজর না দিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষা দিতে হবে।
(সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।)

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ২১ দিন আগে