খুলনা | সোমবার | ১২ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

মাতৃভাষায় কুরআন শিক্ষা কেন জরুরি

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
১২:৫৮ এ.এম | ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২২


চলছে ভাষার মাস। ভাষা মহান আল­াহ তায়ালার এক বিরাট নেয়ামত। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষার জন্য ১৯৫২ সালের এই মাসে জীবন দিয়েছিল বেশ কয়েকজন তরতাজা যুবক। নিজের ভাষায় কোন একটি বিষয় যেভাবে বুঝা যায়, অন্য কোন ভাষাতে তা বুঝা সম্ভব নয়। কুরআন একটি জীবন্ত মু’জেজা। সমগ্র মানুষের জন্য তা জীবনব্যবস্থা বা কোড অব লাইফ। একজন সচেতন মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রত্যেককেই পবিত্র কুরআন শরীফ আমাদের নিজ মাতৃভাষা বাংলায় বুঝে পড়ার দরকার। কারণ, মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, অন্য কোনো ভাষায় তা বোঝানো সম্ভব নয়। মাতৃভাষা শুদ্ধ করে চর্চা করা নবীর অনুপম সুন্নত। রসুলুল­াহ (সাঃ) নিজে তার মাতৃভাষা আরবিকে ভালবাসতেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।’ মাতৃভাষার মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা ও ইসলাম চর্চার প্রতি আমাদের ভারত উপমহাদেশের বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামও যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছেন। হজরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহঃ) তাঁর এক ছাত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘যদি হিন্দুস্থানে দ্বীনি খেদমত করতে চাও, তবে নিজ ভাষায় যোগ্যতা অর্জন করো।’ প্রখ্যাত মনীষী সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) বলেন, ‘কোনো দেশে দ্বীনি খেদমত করতে আগ্রহী ব্যক্তিকে সে দেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি বোধ পূর্ণমাত্রায় অর্জন করতে হবে’। শাইখুল হিন্দ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) বলেন, ‘যতক্ষণ না তোমরা আপন ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে, ততক্ষণ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।’ এছাড়া প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ‘প্রত্যেকেরই শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষা হওয়া উচিত। অপর ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর’। এ ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন, তোমার বন্ধুর পত্র পেলে কত আগ্রহ ভরে পড়। না বুঝলে বোঝার চেষ্টা করো। তোমার মালিক মহান আল­াহ তায়ালা কুরআন আকারে তোমার কাছে একটি পত্র পাঠালেন, অথচ তুমি তা কখনও পড়ে দেখলে না, বুঝলে না। আল­াহ তায়ালা যেন বলেন, আমি কি তোমার বন্ধুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেলাম?
পবিত্র কুরআনে মহান আল­াহ তায়ালা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান উপদেশ, আদেশ, নিষেধ প্রদান করেছেন। এগুলো বাংলা ভাষায় না জানলে আমরা কিভাবে তার উপর আমল করতে পারবো? উদাহরণ স্বরূপ- সূরা মুতাফফিফীনে আল­াহ জাল­াশানুহ এরশাদ করেন, “যারা মাপে কম করে, তাদের জন্যে দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে। সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়, নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকবে (সূরা মুতাফফিফীন : ১-৭)”। অনেক ব্যবসায়ী মুসল­ী আছেন যারা এই সূরা নামাজে শুনছেন, আবার ঠিক একটু পরেই দোকানে গিয়ে মাপে কম দিচ্ছেন। তারা যদি এই সূরার অর্থ মাতৃভাষা বাংলায় বুঝতেন তাহলে হয়তবা তারা মাপে কম দেয়া ছেড়ে দিতেন। প্রকৃত পক্ষেই মাতৃভাষায় কুরআন বুঝা এবং জীবনে তার বাস্তবায়ন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আল­াহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, “তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা আল­াহর এক অন্যতম নিদর্শন (৩০:২২)। সূরা আর রহমানে আল­াহপাক বলেন, “করুণাময় আল­াহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন ভাষা (আয়াত ১-৪)”। ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল­াহ তায়ালা সকল নবীকেই পাঠিয়েছেন তার নিজস্ব মাতৃভাষায়। আল­াহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিস্কার ভাবে বোঝাতে পারেন (সূরা ইব্রাহিম : ৪)। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রধান চারটি আসমানী কিতাবের মধ্যে হজরত মুসা (আঃ)-এর প্রতি ‘তাওরাত’ ইবরানী বা হিব্র“ ভাষায়, হজরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানী বা সিরিয়ার ভাষায়, হজরত দাউদ (আঃ)-এর প্রতি ‘যাবুর’ ইউনানী বা আরামাইক ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর প্রতি ‘আল-কুরআন’ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। যদি আল­াহ তায়ালা এভাবে নবী-রাসূলদের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে আসমানী কিতাব প্রেরণ না করতেন, তবে দেশবাসী ঐশী ধর্মগ্রন্থের হেদায়ত ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতো। মহানবী (সাঃ) মাতৃভাষা বিশুদ্ধ ভাবে শিক্ষা ও চর্চার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের কখনই অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ মাতৃভাষা ছাড়া মহান আল­াহর কোন কথাই আমরা বুঝতে পারব না। নামাজে ইমাম সাহেব সাধারণত কুরআনের শেষ দিকের ছোট ছোট সূরাগুলো পড়ে থাকেন। এগুলোর অর্থ কি আমরা সাধারণ মুসল­ী বুঝি? বুঝলে ভয়ে দীল কেঁপে উঠত; চোখে পানি চলে আসত। উদাহরণ স্বরূপ, নামাযে বহুল পঠিত যিলযাল (ভূমিকম্প), তাকভীর (গুটিয়ে নি¯প্রভ করে ফেলা), ইনফিতার (বিদীর্ণ করা), আল ক্বরিয়াহ (করাঘাতকারী মহাসঙ্কট) প্রভৃতি সূরাতে কেয়ামতের যে ভয়াবহ বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে কোন মুমিনের অন্তর প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। সূরা মাউন (আরআইতাল­াজি) জানেন না এমন মুসলি­ খুব কম আছেন। কিন্তু অর্থ জানেন কয় জন? এই একটি ছোট্ট সূরা মানুষের আখলাককে পরিবর্তন করতে পারে; পারে গরীব ও প্রতিবেশীর প্রতি তার মনোভাবকে পরিবর্তন করতে। মাউন শব্দের বাংলা অর্থ, সামান্য সহযোগিতা, যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন জিনিস প্রতিবেশীকে ধার দেয়া। এ প্রসঙ্গে মহান আল­াহ কি বলেন দেখুন- “আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না (সূরা মাউন : ১-৭)।” কি চিত্তাকর্ষক বাণী তাই না? এই সূরাতে এতিম ও গরীবদের সাহায্য করার পাশাপাশি নিত্য ব্যবহৃত জিনিস, যেমন পানি, লবণ, কাস্তে, কোদাল, বাসনপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনের সময় প্রতিবেশীকে ধার দেবার উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আসলেই, আমরা যদি অর্থ জেনে কুরআন পড়ি তাহলে তা আমাদের জীবনকে বদলিয়ে দিতে পারে। সংশোধন হতে পারে আমাদের খারাপ চরিত্র। মহান আল­াহতায়ালা আমাদের পবিত্র কুরআন বুঝে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করেন।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে