খুলনা | শুক্রবার | ০৪ জুলাই ২০২৫ | ২০ আষাঢ় ১৪৩২

মানবসৃষ্ট যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষকে, এটা প্রকৃতির আশির্বাদ না অভিশাপ, নাকি চরম প্রতিশোধ

স্নিগ্ধা মৌ ঘোষ |
০১:৫২ এ.এম | ১৪ মে ২০২২


স¤প্রতি কোন কারণে ভীষণ বিপর্যস্ত আমি। অফিস থেকে বেরিয়ে এটিএম বুথে গেলাম টাকা তুলতে। আমি দরিদ্র মানুষ, ব্যাংকের ২/১ হাজার টাকা অতি মূল্যবান, জীবন-যাপনের অংশ। বেশ সহজ ভাবেই বুথে ঢুকলাম, কার্ড প্রবেশ করালাম নির্ধারিত স্থানে। কিন্তু বিধিবাম! মানসিক অস্থিরতার কারণে কোন ভাবেই কার্ডের জন্য নির্ধারিত পিন সংখ্যা মনে পড়লো না। স্মৃতির ওপর কিছুটা ভরসা করে চারটি ডিজিট দিলাম। কিন্তু কাজ হলো না। আমাকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করে কার্ডটি বেরিয়ে আসলো। আবার কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে দ্বিতীয় বার চেষ্টা করলাম। ভাগ্যদেবী সহায় হলেন না, আবার কার্ডটি বেরিয়ে আসলো। তৃতীয়বার চেষ্টা করার সাহস বা ইচ্ছে কোনটাই হলো না কারণ শুনেছি তিনবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলে কার্ড আটকে যাবে। লোকলজ্জার একটি বিষয়। মানুষ আবার কি ভাববে কারণ মানুষ কি ভাববে, এটা ভেবেই জীবনের অর্ধেক সময় পার করে দেই আমরা। ফলাফল হিসেবে আরো বেশি বিপর্যস্ত হয়ে এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে আসলাম। বুথ ইনচার্জও বেশ কৌতূহল চোখে লক্ষ্য করছেন। তবে গ্রাহক সেবায় উদার আন্তরিকতার ঘাটতি থাকতে নেই বলেই বোধ হয় তিনি প্রশ্ন করলেন না। বুথের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে নিশ্চয়ই খুব উদভ্রান্তের মতোই লাগছিলো।
বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই আমাদের। প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে যন্ত্র ছাড়া জীবন অচল। অদূর ভবিষ্যতেও আমরা সহজ জীবনযাপন এবং উন্নত জীবনের জন্য প্রযুক্তি নির্ভরতা আরো বাড়িয়ে দিবো। তবে কিছু বিষয় কি আমরা বুঝতে চাইছি না, নাকি বুঝতে পারছি না? উন্নয়নের জোয়ারে জীবন এখন অনেক সহজ, এসেছে সহজলভ্যতা। কিন্তু একই সাথে আমরা কি অনেক কিছু হারিয়ে ফেলছি না? অনেক কিছু পাওয়ার জন্য অনেক অধিকারও কি আমরা ক্রমান্বয়ে বিসর্জন দিচ্ছি না? টাকা তোলার জন্য মাত্র চারটি ডিজিটের কাছে আমার অধিকার জিম্মি। মাত্র চারটি ডিজিটের কাছে নিরুপায় আমার মালিকানা। মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুর ওপর যথাযোগ্য প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি, সঠিক ডিজিট মনে পড়ে নি আমার। অথচ টাকাটি ভীষণ দরকার ছিল সেই সময়। আমি কোনভাবেই এটিএম বুথের বিপক্ষে নই। যখন তখন টাকা তোলা এবং সহজ জীবনের জন্য অপরিহার্য এটিএম বুথ। এটি শুধুই একটি উদাহরণ। মূল বিষয় প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা। যন্ত্রও যন্ত্রণা দেয়, ভীষণ ভাবেই যন্ত্রণা দেয়। 
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিরে যেতেও চাই না আমরা। কিন্তু জীবনযাপনের এই ধারা আমাদের জন্য সঠিক তো? সারোগেসি পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদান এখন বেশ প্রচলিত এবং বলা চলে ট্রেন্ড। সারোগেসি পদ্ধতি মূলত কোন স্ত্রী যদি গর্ভধারণে অক্ষম হন, বা গর্ভধারণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়, অথবা অবিবাহিত কোন নারী বা পুরুষ যদি সন্তান চান কিংবা সমকামী দম্পতির জন্য। কিন্তু এখন অনেকেই স্বাভাবিক গর্ভধারণের পরিবর্তে এই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন। আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আর্থিকভাবে সাবলম্বীদের মধ্যে বিষয়টি জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বাড়ছে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিসরে হয়তো ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য নেই। আশা করা যায় উন্নয়নের জোয়ারে এক সময় এই পদ্ধতিও সকলের ক্রয়ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হবে। তখন হয়তো সারোগেসি হয়ে উঠবে একটি পেশা। হতেই পারে। কম বুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবেই মনে ছোট একটি প্রশ্ন আসে, আমাদের এই যাত্রাপথ সঠিক তো? প্রকৃতির এত বিরোধিতা সহ্য হবে তো?
মানুষকে আরো শান্তিপূর্ণ সহজ জীবনের জন্য রোবট আবিস্কার। নির্ভুল যার কাজ। কোথাও কোথাও এই রোবটই নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষকে। আমরা মেনে নিচ্ছি রোবটের দেওয়া নির্দেশনা। জীবনযাপনের তাগিদে পশু-পাখি শিকারের জন্য অস্ত্র আবিস্কার বা প্রয়োগ যেভাবেই সূচনা হোক না কেন, আমরা এখন মানুষ শিকারে ব্যস্ত। আমাদের অস্ত্র বিষয়ক চিন্তাধারা এখন ক্ষমতা এবং অর্থকেন্দ্রিক। পারমাণবিক শক্তির কথা বাদই দিলাম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হোক না কেন, ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ প্রধান ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের ব্যবহারের ফলে বদলে গেছে তার ধরণ। ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে উঠেছে কেউ কেউ। ফেসবুকে “What’s on your mind” এ আমরা আমাদের অনুভূতি গুলো স্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরতেও দ্বিধা করি। মানুষ কি ভাববে এই চিন্তায় সময় কেটে যায়। প্রতিদিন কেউ ভালো থাকে না, মন খারাপ হতেই পারে। তবে পোস্ট দিলেই শুরু হবে গবেষণা। কেউ ঘুরতে পছন্দ করলে অথবা আনন্দের পোস্ট করলেও মুক্তি নেই। আমরা শো-অফ কিংবা attention sicker  টাইটেল বসিয়ে দেই কিছু না ভেবেই। সুতরাং মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা বোধহয় দূরেই সরে আসছি।
বর্তমান যুগে প্রযুক্তি ছাড়া জীবন সম্ভব নয়। আমিও এর বিপক্ষে যাবো সেই সাধ্য বা ইচ্ছা কোনটাই নাই। কিন্তু স্বাধীনতা পেতে যেয়ে আমরা কি পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি হয়ে পড়ছি না? বেশ কিছু বিষয়ে যন্ত্রের হাতে আমরা বন্দি। সায়েন্স ফিকশানের অতি আধুনিক জগতে যন্ত্রের হাতে মানুষের বন্দি জীবনযাপন যেন আমাদের ইঙ্গিত দিয়ে গেছে ভয়ানক ভবিষ্যতের। মানবসৃষ্ট যন্ত্র এখন নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষকে। এটা প্রকৃতির আশির্বাদ না অভিশাপ না কি চরম প্রতিশোধ, ভেবে দেখার অবসর হবে কি আমাদের?

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ১১ দিন আগে