খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

আবেগতাড়িত আচরণ ও নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০২:০৫ এ.এম | ১৭ জুলাই ২০২২


কেস নং-১, শিরীন (ছদ্ম নাম) বয়স ১৮ বছর। সে যখন রেগে যায় তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। রেগে গেলে সে নিজের শরীরে নিজেই আঘাত করে থাকে। রাগের মুহূর্তে নিজের সম্পদের বা অন্য কারোর সম্পদের ক্ষতি করতে তার কোন দ্বিধাবোধ সৃষ্টি হয় না। মোট কথা রেগে গেলে সে তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়।
কেস নং:-২, সীমন (ছদ্ম নাম) বয়স ১৭ বছর। সে অত্যন্ত গোপন কোন কোন বিষয়কে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে প্রায় সময় সে অক্ষম হয়। সে কথা বলতেও বেশ পটু। যখন সে কথা বলা শুরু করে, প্রায় সময় তার আগ পাছ কিছুই না ভেবেই কথা বলে ফেলে।
উপরের দু’টি বিষয়কে বিশ্লেষণ করলে -আমরা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য আচরণে আবেগ প্রবণতামূলক প্রবণতা দেখতে পাই। মানুষ যখন কোন আচরণ সংঘটিত করে, বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রে সে সব আচরণের উপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকে। তবে কোন কোন ব্যক্তি বেশির ভাগ সময় তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়- যেটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আবেগপ্রবণ আচরণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। মূলত: আবেগময় আচরণ হলো সুষ্ঠু বিচার বিশ্লেষণ ব্যতীত এবং ভবিষ্যতের ফলাফলের চিন্তা ব্যতিরেকে কোন পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া করা। জীবনে চলার পথে অহরহ: আমরা অসংখ্য এরূপ আচরণ করে থাকি যা ইচ্ছা করলেও অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এরূপ আচরণের ফলে ব্যক্তিকে মাঝে মধ্যে জীবনে বড় ধরণের বিপদের সম্মুখীনও হতে হয়। 
আবেগপ্রবণ আচরণের লক্ষণ: আবেগপ্রবণ আচরণের লক্ষণ সমূহ হলো- 

(১) অনিয়ন্ত্রিত  মানসিকতা: ব্যক্তির মধ্যে কোন কোন কাজ বিশেষ করে কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, জুয়া খেলা বা অন্য কোন কাজকে বেশি প্রশ্রয় দেয়ার স্বভাব বিদ্যমান থাকে। (২) ক্ষুদ্র বিষয়কে বড় করে চিন্তা করা: ক্ষুদ্র কোন সমস্যাকে বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বড় করে দেখা বা অপেক্ষাকৃত বেশি প্রাধান্য দেওয়া। (৩) ওভার শেয়ারিং: ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে গোপন ও একান্ত নিজস্ব কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে বাধ্য হওয়া। (৪) সম্পদ নষ্ট করা: রাগের মুহূর্তে নিজের সম্পদ বা ঘরের জিনিসপত্র অথবা অন্যকারোর সম্পদ নষ্ট করার প্রবণতা। (৫) নিজের শারীরিক ক্ষতি সাধন: অতিরিক্ত রাগের মুহূর্তে নিজের শারীরিক ক্ষতি নিজেই সাধন করা।(৬) অহেতুক উৎসাহ: তুচ্ছ বা অনাবশ্যক কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে বার বার উৎসাহ দেখানোর স্বভাব বিদ্যমান থাকা। (৭) অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার: মোবাইল গেম বা অন্য কোন বিষয়ে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রবণতা বিদ্যমান থাকা।

শিশুদের মধ্যে আবেগপ্রবণ আচরণের লক্ষণ: 

(১) বিপদের সম্ভাবনাকে আমলে  না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ। (২) বড়দের বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্কে কথোপকথনের মধ্যে অযথা হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা।(৩) শিশু রাগান্বিত হলে অন্য শিশুকে শারীরিক আঘাত করা প্রবণতা । (৪) শিশুর যাহা পছন্দ, তাহা অন্যের হলেও চিন্তা না করে বা মালিককে না বলে অথবা সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে গ্রহণ করার মানসিকতা বিদ্যমান (৫) হতাশার মুহূর্তে চিল­াচিলি­ করা বা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি করা। 

ব্যক্তির আবেগপ্রবণ আচরণের কারণ: 

(১) মস্তিষ্কের ফ্রন্ট্যাল লোব সমস্যা: যাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্ট্যাল লোব কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে বিচার বিবেচনা বোধ কম থাকে। এ প্রকার লোক সহজে আবেগীয় আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। (২) ব্রেইন ক্যানেকটিভিটি: ব্রেইন ক্যানেকটিভিটি তিন প্রকার-(!) এন্যাটোমিক্যাল (!!) ফ্যাংসানাল (!!!) ইফেকটিভ, গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রেইন ক্যানেকটিভিটির যে কোন নেটওয়ার্কে সমস্যা হলেই মানুষের আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।(৩) বংশগত সমস্যা: বংশে কোন ব্যক্তির আবেগজনিত আচরণগত সমস্যা থাকলে,তাদের সন্তানদের মধ্যে এ প্রকার সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। (৪) বয়স ও লিঙ্গজনিত কারণ: পুরুষদের মধ্যে ও যুবক বয়সে আবেগীয় আচরণের প্রবণতা বেশি থাকে। (৫) পরিবারিক ইতিহাস : পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতাজনিত রাগ বিদ্যমান থাকলে তাদের আবেগীয় আচরণ প্রবণতা বেশি বিদ্যমান থাকে। (৬) অন্যান্য মানসিক সমস্যার সাথে সহ-সম্পর্ক: আবেগীয় আচরণের সাথে আরো কিছু মানসিক রোগের গভীর সহ-সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে উদ্বেগজনিত মানসিক সমস্যা, হতাশা বাইপোলার ডির্স-ওয়ার্ডার, পোষ্ট ট্রমেটিক স্ট্রেস ডির্স-ওয়ার্ডার, সমাজ বিরোধী ব্যক্তিত্বের মানসিক সমস্যা, ওডিডি বা পিটিএসডি থাকে তাদের মধ্যে আবেগীয় আচরণ প্রবণতা দেখা দিতে পারে।

আবেগীয় আচরণ নিয়ন্ত্রণের উপায়: 

(১) ব্যক্তিকে সচেতন করা: ব্যক্তির উপলদ্ধিতে যদি আবেগীয় আচরণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সত্যিকার বোধগম্যতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়,তবে ব্যক্তির আবেগীয় আচরণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। (২) ধৈর্যের প্রশংসা করা: ব্যক্তি/ শিশু কখনো যদি আবেগীয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়, তখন তার কাজের জন্য তাকে প্রশংসা করা প্রয়োজন। (৩) রিল্যাক্সসেসন থ্যারাপি ( ডিপ ব্রিদিং প্রাকটিস) : যখন নিজের মধ্যে আবেগীয় আচরণের উদ্ভব হওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়, তখন গভীর নিঃশ্বাস নিতে হবে এবং ৩ সেকেন্ড আটকে রেখে আবার জোরে ছেড়ে দিতে হবে। এভাবে কয়েক বার অভ্যাস করলে ইচ্ছার উপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। (৪) অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসা: ব্যক্তির ভিতর যদি অন্য কোন মানসিক রোগ থেকে থাকে, তার জন্য দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ গ্রহণ সাপেক্ষে মানসিক রোগ নিরাময়পূর্বক আবেগীয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
আবেগীয় আচারণ যেমন আপনার জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তাহা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এরূপ আচারণ আপনার নিজের জীবনের জন্য, আপনার পরিবারের জন্য ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই এরূপ সমস্যা দেখা দিলে একজন দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ গ্রহণ করে আপনিও সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে পারেন। 
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান  বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা। 
Email: prokashad1173@ gmail.com

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে