খুলনা | বুধবার | ০২ জুলাই ২০২৫ | ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

‘অন্তরের অতৃপ্তিতা রয়েই গেল’

নিজস্ব প্রতিবেদক |
১২:৫৪ এ.এম | ১৭ জুলাই ২০২১

খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষক শিক্ষাবিদ প্রফেসর মেজর (অবঃ) মোঃ বজলুল করিমের হৃদয়ে প্রকৃত সত্য, বস্তুনিষ্ঠ অতীত ও শেকড়ের কথা শিখরে তুলে ধরার অপ্রাণচেষ্টা ছিল। গবেষণার প্রয়োজনে অর্থ, সময় ও দূরত্ব কোন বাধা হতে পারেনি তাঁর। তাই তো সুদুর কলকাতা থেকে বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসিনের হাতে লেখা দলিল সংগ্রহ করেন তিনি। মুসলিমদের শিক্ষা বিস্তারে বিরল ভূমিকা রাখলেও বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করা হয়নি মহান দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসিনকে। অন্তরের সেই নিগাঢ় অতৃপ্তিতা ‘সময়ের খবর’র সাথে একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেছিলেন বি করিম স্যার। এর মধ্যে ২০১৬ সালের জুনে সময়ের খবর’র সিনিয়র রিপোর্টার আশরাফুল ইসলাম নূরের সাথে ইতিহাসবিদ বি করিম স্যারের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের সামনে হু-বহু তুলে ধরা হলো।

‘শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তবে সমাজে বৈষম্য কমছে না’
‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ খ্যাত সরকারি বিএল কলেজের মন্দিরের পুরোহিতকে সরকারি বেতন দেয়া হয়। তবে মসজিদের ইমাম বা মোয়াজ্জিনকে সরকারি বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। প্রতি বছর এই ক্যাম্পাস থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বের হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তবে সমাজের বৈষম্য কমছে না।’ উপরোক্ত কথাগুলো বিরতীহীন ভাবে বললেন প্রফেসর মেজর (অবঃ) মোঃ বজলুল করিম। অর্ধশতাধিক গ্রন্থের এই রচয়িতা সময়ের খবর’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে নগরীর দৌলতপুর পাবলার ২নং ক্রস রোডের ৮৭নং হোল্ডিং ‘অবকাশ’ নামের নিজ বাস ভবনে বসে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।
তিনি মনে করেন, প্রত্যেকটি মানুষকে বই পড়তে হবে। শুধু বই পড়লেই হবে না; পঠিত বিষয়বস্তু দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। আশিতিপর ওই গবেষক ও ইতিহাসবিদ বিএল কলেজে অধ্যাপনার সময় থেকেই বি করিম স্যার নামেই অধিক পরিচিত লাভ করেছিলেন। এখনো তিনি এ অঞ্চলের বিদ্যাপীঠে ও শিক্ষানুরাগীদের কাছে তিনি সে নামেই খ্যাত।
বর্তমানে প্রাইভেট পড়া বা ব্যাচ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমি জীবনে কোনদিন প্রাইভেট পড়িনি। শিক্ষকতা জীবনে কোনদিন প্রাইভেট পড়ায়নি। যে ছাত্র প্রাইভেট পড়ে তার স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যায়। যে শিক্ষক পড়ান তার উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষার্থীকে পাস করিয়েই অর্থ উপার্জন করা। এতে করে শিক্ষার্থী কখনোই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। তাই প্রাইভেট পড়াটা ঠিক নয়। একজন শিক্ষার্থী যদি প্রতিদিন ২টি করে নতুন শব্দ শেখে, তাহলে বছরে সাতশ’র মতো শব্দ শেখে। পাঁচ ভুলে গিয়েও যদি সে বছরের দুইশ’ শব্দ মনে রাখতে পারে; তবে একটা ছেলে মাধ্যমিক স্তরে গিয়েই বাক্য তৈরি করতে পারবে। গ্র“প ডিসকারশনে জোর দিতে হবে।
বিএল কলেজের দর্শন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান বি করিম স্যার আরো বলেন, একটা ছেলেকে যদি বলা হয়-খুলনায় ১০ বছর বাস করছো; খুলনা সম্পর্কে ৫ মিনিট বলো। সে কিন্তু পারছে না! একটা ছেলে হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজে পড়ে তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়; হাজী মুহম্মদ মুহসিনের জন্ম কবে? মৃত্যু কবে? সে কিন্তু বলতে পারছে না। 
বিএল কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনায় তিনি বললেন, ব্রজলাল বাবু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫৪ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯০২ সালে ৫৪ হাজার টাকার মূল্য অনেক। এই টাকা দিয়ে তিনি ২ একর জমি কিনেছিলেন। বর্তমান যেখানে মন্দির; ওই এলাকা দিয়ে দু’টি ঘর তৈরি করেছিলেন। কলেজটি করতে চাইলেন আবাসিক এবং এখানে শুধুমাত্র হিন্দুরাই অধ্যায়ন করার সুযোগ পাবে। তখন পরিদর্শন যারা এলেন তার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কলেজটিতে শুধু হিন্দুরাই পড়ালেখা করবে। তাহলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা কি করবে? ব্রজলাল বলেছিলেন, সেটা তারা জানে। ১৯০৪ সালে ৫ এপ্রিল একটা দলিল তৈরি করেছিলেন (খুলনা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের ১৪৬৩নং দলিল)।
দলিলে লেখা ছিল-শুধুমাত্র হিন্দুরাই এ কলেজে পড়তে পারবে। পরে আবার পরিদর্শক এসে তার কাছে জানতে চাইলেন-আপনি (ব্রজলাল বাবু) তো শুধু হিন্দু স¤প্রদায়ের জন্য কলেজ নির্মাণ করছেন; তা অন্য স¤প্রদায়ের ছেলেরা কোথায় যাবে? আর আপনি দৌলতপুর হিন্দু একাডেমির (কলেজের) প্রয়োজনীয় জমি কোথায় পাবেন? ব্রজলাল বলেছিলেন, জমি আছে। এই যে এইসব। পরিদর্শকরা বললেন, মহেশ্বরপাশা মৌজা, এসব জমি তো হাজী মুহম্মদ মুহসিনের জমি। এক লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ একর জমি ছিল হাজী মুহম্মদ মুহসিনের। খুলনাতে ৮ হাজার বিঘা জমি ছিল। খুলনার ডিসি অফিসে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের ফান্ডে অন্তত দুই কোটি টাকা জমা রয়েছে। ১৮১২ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি মারা যান। সে সময়ে তিনি নগদ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রেখে যান। এসব সম্পত্তি সম্পর্কে এক দলিলে তিনি বলে যান-এসব সম্পত্তি (শিয়া) মুসলিমদের কল্যাণে, শিক্ষা ও উপাসনার কাজে ব্যয় করা যাবে। ইমামদের বেতন-ভাতা দেবার কথাও লেখা ছিল তার দলিলে। সে দলিল অনুযায়ী ১৯০৭ সালের ৩০ এপ্রিল খুলনার তৎকালীন (খুলনার প্রথম ডিসি) জেলা প্রশাসক আহসান আহমেদ মুসলমানদের শিক্ষার সুযোগ দেবার শর্তে জমি দেবার পথ সুগম করলেন।
১৯১২ সালে ব্রজলাল বাবু একটা ছোট্ট পুস্তিকায় লিখেছেন, ১৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৪০ একর জমি দিয়েছে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের ফান্ড থেকে পুস্তিকাতেই লেখা আছে তারই জায়গাতে কলেজটি নির্মিত।
১৯৪৪ সালে ব্রজলাল মারা যান। আর ১৯৪৬ সালের ২২ মে পর্যন্ত দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী নামেই চলেছিল আজকের বিএল কলেজ। তবে ১৯৩৭ সালে একজন মুসলিম শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে কলেজ অভ্যন্তরে পাঠদান করতে বা থাকতে দেয়া হতো না। হিন্দু একাডেমির ওই এলাকাটা পবিত্র তাই----! ১৯০৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি এখানে আসলেন। তিনি বললেন, হাজী মুহম্মদ মুহসিনের জমিতে এই কলেজ চলছে; এই কলেজে একটি মুসলিম ছাত্রাবাস নির্মাণ ও মুসলিমদের ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। ১৯২৪ সালে শেরে বাংলা এ কে বজলুল হক শিক্ষামন্ত্রী থাকাবস্থায় তখনার উচ্চ ভাষা ফারসি শেখার জন্য মুসলিম ছাত্রদের জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। বিএল কলেজের প্রথম মুসলিম ছাত্র ছিল মোঃ একরাম উদ্দিন ও সৈয়দ নওসের আলী। ১৯৫২ সালে সর্বপ্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ আসেন এনামুল হক। এমনি অজানা ইতিহাস নিয়ে তার লেখা বিএল কলেজের অর্ধশতাব্দী প্রকাশনার অপেক্ষায়। তারমতে, ভারতের হুগলি কলেজের ক্ষেত্রে হাজী মুহম্মদ মুহসিনের নামটির প্রতি অবিচার করা হয়েছিল।
মনের কোণে কিছু না পাওয়ার কষ্টও রয়েছে তার। তিনি বললেন, প্রাক্তন ছাত্রদের সমন্বয়ে বিএল কলেজ এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলো। তাই বলে কি, প্রাক্তন শিক্ষকরা সেখানে থাকতে পারবেন না? খুব ইচ্ছা ছিল তাদের প্রোগ্রামগুলোতে উপস্থিত থাকবো। কিছু কথা বলবো। সে জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ৮০০ টাকাও জমা দিয়েছিলাম সদস্য পদ লাভের জন্যে। কিন্তু তারপর কখন কি হলো, কিছুই জানতে পারলাম না। বিএল কলেজের ইতিহাস সম্বলিত বৃহৎ আকৃতির একটা গ্রন্থ রচনা করলাম কর্তৃপক্ষ একটা ধন্যবাদও দিলো না! শুধু সান্ত্বনা পাই, বিএল কলেজের দু’জন ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য ও দুই স্পিকার হয়েছেন। কবি গোলাম মোস্তফা ও চলচিত্র অভিনেতা গোলাম মোস্তফাসহ সারাবিশ্বে অসংখ্যা প্রাক্তন শিক্ষার্থী সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
বি করিম স্যারের রচিত বইয়ের উলে­খযোগ্য কয়েকটি হলো : আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞানের রূপরেখা (অনার্স শ্রেণির জন্য), অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ (অনার্স শ্রেণির জন্য), উচ্চ মাধ্যমিক সহজ যুক্তিবিদ্যা, অবরোহ ও আরোহ খন্ড, হেগেলোত্তর দর্শন (অনার্স এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য), অনার্স শ্রেণির জন্য উচ্চতর যুক্তিবিজ্ঞানের ভূমিকা (প্রতীকী), ব্রজলাল (বিএল) কলেজের ইতিহাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে খুলনার দৌলতপুর, শিক্ষা ও প্রশাসনে মন্দির-মসজিদের ভূমিকা, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস-সমকালীন (সহযোগী লেখক), কালা মিয়া’র ঘাট ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব (সহযোগী লেখক), বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর বিবর্তণের ধারায়, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরকে যেমন দেখেছি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রকৌশলী এস এম শহীদুল­াহ ঃ জীবন ও কর্ম, বিএল কলেজের অর্ধশতাব্দী (১৯০২-১৯৫২), মতাত্মা মন্নুজান ও মহষি মহসীন-এর অবদান ও গুণাবলী, সাদমান সিদ্দীকি তেনজিৎ-এর জীবনালেখ্য, পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মে ও বিকাশ ও অলিম্পিক ও ফুটবলের সন্ধানে এবং শৈল্পিক ফুটবলে ‘রুমী-রা’।
জন্ম পরিচয়, শিক্ষা ও কর্মজীবন : প্রফেসর মোঃ বজলুল করিম ১৯৩৮ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মহকুমার করিমপুর থানা চেচানিয়া দেওয়ানের পাড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- রফিক উদ্দিন আহমেদ ছিলেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা এবং মা বিধুজান বেগম (নক্সীকাঁথা শিল্পী) গৃহিনী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স) এবং এমএ (দর্শন) ডিগ্রি লাভ করেন। কয়েকটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৬২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকারি বিএল কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। অধ্যাপনার সুবাদে সাবেক ইউওটিসি’র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সামরিক বিভাগে শুধু কমিশনপ্রাপ্ত হননি; সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থেকে ক্রমান্বয়ে বিএনসিসি’র মেয়র পদ মর্যাদা লাভ করেন। অবসর নিয়েই বসে থাকেননি তিনি-১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯সাল পর্যন্ত খুলনা জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের খন্ডকালীন শিক্ষক। এ সময়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস রচনাও করেছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেন এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। সহধার্মিণী লায়লা আরজুমান্দ’র অনুপ্রেরণায় নগরীর দৌলতপুরের পাবলা ২নং ক্রস রোডের ৮৭নং হোল্ডিংয়ের নিজ বাসভবনে অবিরত লিখছেন। বড় ছেলে রানা এজাজ করীম প্রবাসী এবং ছোট ছেলে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রুমি রিজভী করিম ও একমাত্র মেয়ে সঙ্গীতশিল্পী সুষমা স্নিগ্ধা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।

্রিন্ট

আরও সংবদ