খুলনা | শনিবার | ৩১ মে ২০২৫ | ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মিথ্যা

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:২২ এ.এম | ০১ অগাস্ট ২০২২


মিথ্যার অর্থ হলো একটি কথার সঠিকটা গোপন করে বানিয়ে ছানিয়ে অন্য একটি কথা বলা। অন্যভাবেও বলা যায়, কোনো ঘটনা বা বিষয়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করাকে মিথ্যা বলে।
সত্যের বিপরীত হচ্ছে মিথ্যা। সত্য হচ্ছে আলো আর মিথ্যা অন্ধকার। সত্য সুন্দর, মিথ্যা কুৎসিত। সুতরাং সত্য ও মিথ্যার কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন বা পৃথক এবং এ দু’টি বিপরীতধর্মী বিষয়।
মানব জীবনে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে মহান আল্লাহ এক এবং তার কোনো শরীক নেই আর সবচেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে শিরক ও কুফর।
যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শক্তিকে শরীক করে তারা সুস্পষ্ট মিথ্যার অনুসরণ করে। আর যে মিথ্যার অনুসরণ করে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে সে মূলত মস্তবড় জালেম।
পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় শিরক একটা বড় জুলুম।’ (সূরা লোকমান:১৩)
এমনিভাবে কুফরীও একটি মিথ্যা। কুফরী হচ্ছে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে কারীমায় অন্যত্র বলেছেন, ‘এটাই প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের পূজা করে সব মিথ্যা। আল্লাহ সর্বোচ্চ মহান।’ (সূরা লোক্বমান:৩০)
একই ভাবার্থে পুনরায় আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন, ‘যারা আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনের ওপর ঈমান আনে না তারাই মিথ্যা-প্রতারণা করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী।’ (সূরা নাহল;১০৫) 
এজন্য মানব জীবনে সবচেয়ে বড় মিথ্যা হচ্ছে, এক ও অদ্বিতীয় মহাপবিত্র সত্তা মহান আল্লাহ এবং তাঁর দ্বীনকে অস্বীকার করা এবং শিরকী ও কুফরী গ্রহণ করা। যা জঘন্য অপরাধ এবং এই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম।
এটি ছিল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সত্য ও মিথ্যা। এছাড়াও আমরা কথা ও কাজে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যা প্রকাশ করে থাকি। 
সাধারণত আমরা ঈমানের দুর্বলতা, গোঁড়ামি, রাগ ও অনুরাগের বশবর্তী হয়ে, কারো প্রতি ভালবাসা, শত্র“তা, হিংসা, বিদ্বেষ, বিভিন্ন স্বার্থ সিদ্ধি, নিজের প্রতি অন্যদের আকর্ষণ করার জন্য, কৌতুকচ্ছলে এবং সাধারণ কথাবার্তায় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মিথ্যা বলে থাকি। মিথ্যা সাক্ষ্য দিই যেমন: মিথ্যা মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে নেওয়া বা দেওয়া, মিথ্যা চারিত্রিক সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা অথবা অন্যদের দেওয়া, মিথ্যা সুপারিশনামা লিখিয়ে নেয়া বা দেওয়া অথবা মিথ্যা মামলা দায়ের করি। এছাড়াও মিথ্যা শপথ করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া এবং বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে মিথ্যা প্রকাশ করি যেমন: অনেককে দেখা যায় বাস্তবে সে প্রফেসর নয়, কিন্তু নামের সাথে প্রফেসর লেখা আরম্ভ করে দেয়। মূলত, প্রফেসর একটি নির্দিষ্ট পরিভাষা যা বিশেষ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অথবা কেউ তার নামের পূর্বে শায়খ বা মাওলানা লেখা আরম্ভ করল। উদ্দেশ্য, সে মাদ্রাসায় পড়ায় বা দ্বীনি কাজের সাথে জড়িত এ কথা প্রকাশ করা। অথচ সে কোনো দ্বীনি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেনি। বর্তমানে অনেকেই আছে যারা নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা অর্জন করেনি, অথচ নামের পূর্বে মাওলানা লিখে, শায়খ লিখে। এটা বাস্তবতার বিরোধী হওয়ায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে। 
মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যাচার করা জঘন্য অপরাধ। মিথ্যা কখনও সুফল বয়ে আনে না। মিথ্যার কারণে অন্তরে কপটতা সৃষ্টি হয়। দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতেই চেহারা বিবর্ণ ও মলিন হয়ে যায়। একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার জন্ম দেয়। কারণ, একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়। এছাড়াও অন্য অনেক বড় গুনাহের উপকরণ হল মিথ্যাবাদিতা। যারা মিথ্যা কথা বলে তারা অন্যদেরও একই রকম মিথ্যাবাদী মনে করে। ফলে সমাজে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এমনকি মিথ্যাবাদী নিজের ওপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কায় সবসময় মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ভোগে। মিথ্যুকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না। মিথ্যাবাদীদের সম্মান না থাকায় সে নির্লজ্জের মতো যে কোন ধরণের কাজে লিপ্ত হয়। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
পবিত্র কুরআনে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। 
মিথ্যা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘মিথ্যাবাদীদের উপর অভিসম্পাত।’ (সূরা আল-ইমরান: ৬১)
কুরআন মাজীদে অন্যত্র মিথ্যাচারী সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘অভিশপ্ত হোক মিথ্যাচারীরা।’ (সূরা যারিয়াত: ১০) 
কুরআন মাজীদে সূরাতুল বাকারায় আল্লাহ পাক মুনাফিকদের যেসকল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন এর মধ্যে নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন মিথ্যা বলাকে। আল্লাহ পাক বলেন, অর্থাৎ ‘তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। একারণে যে, তারা মিথ্যা বলত। মিথ্যায় অভ্যস্ত ছিল।’ (সূরা বাকারা:১০) 
মিথ্যার পরিণাম হাদীসে বর্ণিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, প্রিয় নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন বান্দা যখন মিথ্যা কথা বলে তখন এই মিথ্যা কথার দুর্গন্ধে ফেরেশতা তার থেকে দূরে সরে যায়। (তিরমিজি)
আমাদের মনে রাখা উচিৎ মুমিন মিথ্যুক হতে পারেনা। 
হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, অর্থাৎ মুমিনের মধ্যে স্বভাবগত বিভিন্ন দোষ-ত্র“টি থাকতে পারে। তবে সে মিথ্যুক ও প্রতারক হতে পারে না। (আলমুসান্নাফ)
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রাসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আচরণের জন্য সবচেয়ে বেশি রাগান্বিত হতেন তা হচ্ছে কেউ মিথ্যা কথা বললে। যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি তওবা করতো ততক্ষণ তাঁর অন্তরে তা বিধতে থাকতো। (তিরমিযী)
আল্লাহই সর্বজ্ঞ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে মিথ্যা পরিহার করে সত্য অবলম্বন করার তৌফিক দান করুন। আমিন। 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।
 

্রিন্ট

আরও সংবদ