খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ: শিক্ষক অবমাননা ও প্রাপ্তি!!

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
০১:৩৯ এ.এম | ০৫ অগাস্ট ২০২২


শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে প্রতি বছর রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। উদ্দেশ্য গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা অর্জন। লক্ষ মানুষকে স্বশিক্ষায় ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। আর কোন দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম নির্ধারক হলো গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা।
গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের সার্বিক নিরাপত্তা। এ নিরাপত্তা যেমন প্রয়োজন আর্থিক, তেমনি তা আবার প্রয়োজন শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও মানসিক। মানুষ গড়ার কারিগর সেই শিক্ষক আজ প্রায় অবহেলিত, লাঞ্ছিত, অবরুদ্ধ। শিক্ষক অবরুদ্ধ মানে শিক্ষকের সৃজনশীল চিন্তা অবরুদ্ধ, শিক্ষক অবরুদ্ধ মানে শিক্ষকের বাক্ অবরুদ্ধ, শিক্ষক অবরুদ্ধ মানে শিক্ষকের শিক্ষা দান অবরুদ্ধ। শিক্ষক অবরুদ্ধ মানে এক কথায় জাতীর আগামী দিনের মুক্তির পথ অবরুদ্ধ।
বর্তমান সমাজ কর্তৃক অর্জিত শিক্ষার প্রাপ্তি ও প্রয়োগ দেখলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে-’ বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে’। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং শ্রেণি ব্যবস্থাপনা থেকে, সমাজ থেকে আমরা যেটা শিক্ষা লাভ করছি, সেটা অনেকটা পুঁথিগত বিদ্যার মাঝে সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। আজ শিক্ষার্থীর শিক্ষা অর্জন অনেকটা বিদ্যাভ্যাস তথা আবরণগত শিক্ষার মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। ফলে যুব সমাজ থেকে শুরু করে প্রৌঢ় প্রায় সবাই সামাজিক সুস্থির আচরণ বিকাশ ধারা হতে বঞ্চিত হয়ে আবরণগত বিদ্যা তথা অস্থির আচরণ ধারায় প্রলুব্ধ হয়ে পড়ছে। অহরহঃ সমাজে তৈরি হচ্ছে অসমপ্রতিযোগিতাপূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত আচরণ বিশ্লিষ্ট অসংখ্য ঘটনা যা রীতিমত জাতি, সমাজ সকলের নিকট অশনি সংকেত রূপে প্রতীয়মান হয়েই চলেছে।
আজ শিক্ষকের মর্যাদা অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখীন। কিন্তু প্রতিটি ধর্ম শিক্ষা ও শিক্ষককে সর্বোচ্চ আসনে আসীন করেছে। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখ এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর, তাঁকে সম্মান কর’ (আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং:৬১৮৪)। হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে, রসূলের পরে ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে জ্ঞান অর্জন করে ও পরে তা প্রচার করে’ (মিশকাত শরিফ)। হিন্দু শাস্ত্র বেদে -বিদ্যা দানকে অত্যধিক সুমহান হিসেবে মর্যাদা দান করা হয়েছে যা শিক্ষকের মর্যাদাকে অত্যধিক সম্মানীত স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
ইদানিং শিক্ষক হেনস্তা, শিক্ষক অপমান, শিক্ষক লাঞ্ছনা এমনকি শিক্ষক হত্যা সচারচর ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা যদি জাতীর মেরুদন্ড হয়, তবে শিক্ষককে অপমান বা হেনস্তা দ্বারা জাতি কখনো জাতীয় মেরুদণ্ডকে সুপুষ্ট রূপ দান করতে সক্ষম হওয়ার কথা নয়। শিক্ষাকে সর্বজনীন সৃজনশীল ভাবধারায় আবর্তনে শিক্ষক মর্যাদা সবার আগে বিবেচ্য। কিন্তু শিক্ষকের বর্তমান কর্মপরিবেশ, শিক্ষা সংক্রান্ত সকল নৈতিক মান বজায়ে শিক্ষকের শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি পরিচালনা ব্যর্থতা, ক্ষেত্র বিশেষ শিক্ষার্থীদের অনৈতিক দাবির প্রতি শিক্ষকের অসমর্থন সূচক মতামত জ্ঞাপন অথবা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির বিপরীতে ব্যক্তি স্বার্থে রাজনীতির অপসংস্কৃতির অতিমাত্রায় প্রয়োগকরণ, ক্ষেত্র বিশেষ প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক শিক্ষার্থীদের আধিপত্যবাদের নিকট শিক্ষকের আপোষহীন নৈতিকতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ, শিক্ষক হেনস্তাকে দিন দিন উস্কে দিচ্ছে।
কিন্তু কি দোষ আমার শিক্ষকের? যদি কোন শিক্ষক দোষ করেই থাকে, তার জন্য আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে, বিচার ব্যবস্থাপনা আছে। আজ আমার শিক্ষক পরীক্ষার কক্ষে দায়িত্ব পালন করতে ভয় পায়, পাছে শিক্ষার্থীর অন্যায্য দাবির প্রতি বিরুদ্ধাচারণ করলে মান সম্মান হারাতে হয়। শিক্ষার্থীর অসমাঞ্জস্য আচরণ দেখলে আজ আমার শিক্ষক সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ভয় পায়, পরে যদি শিক্ষককে হেনস্তা হতে হয়। আজ আমার শিক্ষক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে আগ্রহ হারায় কারণ পিছে অবরুদ্ধ হতে হয়। 
শিক্ষকের সৃজনশীল মেধার চর্চা, শিক্ষার্থীর সৃজনশীল জ্ঞান অর্জনের পথকে উন্মুক্ত করে। শিক্ষকের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ,  শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে, শিক্ষকের শিক্ষক সুলভ ভাবনার বিকাশ ও প্রয়োগ, শিক্ষার্থীর মানবিক মূল্যবোধ বিকাশ ও ভাবধারায় সন্নিবেশিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। সে জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষক বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ সমায়ের একান্ত অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
শিক্ষক সত্যের পূজারী। সত্য বলার সাহস শিক্ষকের জন্য কোন করুণা নয়, বরং তা শিক্ষকের পেশাগত অধিকার। সত্য কাজ, সত্য বাক্য, সত্য পথ অনুসরণ করা শিক্ষকের কোন দোষ নয়, দোষ তার-যিনি শিক্ষককে সত্য বলার বা সঠিক পথে চলার সাহস যুগিয়েছেন। দোষ সেই বিধাতার যিনি শিক্ষককে ন্যায়ের পথে চলার শক্তি দিয়েছেন। তাকে দণ্ড দেবার মত সাহস বা ক্ষমতা আমাদের কারোরি নাই। আমরা চাই নিরীহ শিক্ষকের প্রতি অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন বন্ধ হোক, না হলে জাতির সত্যিকারের মুক্তি কোন দিনই সম্ভব নয়। 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে