খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

রাগ!

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০১:২৭ এ.এম | ২৪ অগাস্ট ২০২২


পকস স্ট্যাডি-১, মাহিন (ছদ্ম নাম), বয়স- ২০ বছর। সে একজন ছাত্র। সে বন্ধুদের সাথে মিশতে পারে না কারণ সে খুব বদমেজাজী হিসেবে খ্যাত। রেগে গেলে প্রায় সে খুব উচ্চ স্বরে ঝগড়া করে এবং প্রায় সময় বাসার জিনিসিপত্র ভেঙে নষ্ট করে। তার সাথে কোন বিষয়কে শেয়ার পর্যন্ত করতে পারা যায় না কারণ সে খুব বদমেজাজী খ্যাত।
কেস স্ট্যাডি-২, সুমনা (ছদ্ম নাম), বয়স- ৩৩। বাসায় ছোট-খাট ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় তার স্বামী ও সন্তানের সাথে ঝগড়া লেগে থাকতো। সম্প্রতি তার ডিভোর্স হয়েছে কারণ এই উচ্চ রাগের জন্য পরিবারের সাথে অভিযোজন করতে সে ব্যর্থ হয়েছে।
রাগ সংক্রান্ত এরূপ অসংখ্য উদাহরণ আমাদের মাঝে বিদ্যমান। সব সময় রেগে থাকেন এমন লোকের সংখ্যা যেমন বিরল নয় আবার তেমনি হুটহাট রেগে যান এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।
রাগের শারীরবৃত্তিয় কারণ : 

(১) বংশগতির ভূমিকা: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে রাগে বংশগতির ভূমিকা রয়েছে। যাদের পরিবারের বাবা-মা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয়ের মধ্যে রাগ প্রবণতা বেশি বিদ্যমান, তাদের বংশধরদের মধ্যে অনুরুপ রাগ প্রবণতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 

(২) প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্সের ভূমিকা: বাস্তবিক পক্ষে মানুষের আগ্রাসী আচরণের মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হলো প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্স। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের প্রিফ্রন্ট্যাল কর্টেক্স তুলনামূলক কম সক্রিয় তাদের আচরণে আগ্রাসী আবেগ তথা রাগ বেশি থাকে। 

(৩) হরমোনের  ভূমিকাগত প্রভাব : আমাদের মানসিক ভারসাম্য বজায়ে রাখতে হরমোনের ভূমিকা অসামান্য। এড্রিনালিন গ্রন্থি হতে নিঃসৃত হরমোন এড্রিনালিন বা নর এড্রিনালিন অথবা কর্টিসোল যখন বেশি পরিমাণ নিঃসৃত হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আচরণে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে এবং রাগ প্রকাশ করে থাকে। 

(৪) ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া- বিভিন্ন প্রকার ঔষধ যেমন: এন্টি-ইপিলিপ্টিক ড্রাগ, বেনজোডায়াজেপিন ড্রাগ ইত্যাদি ঔষধ সমূহের ব্যবহার আমাদের রাগ প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। 

(৫) ব্যক্তির মেডিকেল কনডিসন: বিভিন্ন প্রকার শারীরিক রোগ যেমন- হার্টএটাক, ডায়াবেটিস, পারকিনসন ব্যাধি, হ্যান্টিংটন কোরিয়া, পিক ডিজিজ, স্ট্রোক ইত্যাদি জনিত রোগে যে সব লোক ভুগে থাকে তাদের মেজাজ স্বাভাবিকভাবেই খিটখিটে থাকে। 

(৬) মানসিক রোগ জনিত কারণ: বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগ যেমন:- ইন্টারমিডিয়েট এক্সপ্লুসিভ ডিস-অর্ডার, ডিমেনসিয়া, অ্যালজাইমার ব্যাধি ও বয়সজনিত অন্যান্য ব্যাধির কারণে মানুষের ভিতর রাগ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। 

(৭) এলকোহল বা বিনোদনমূলক ড্রাগ: এরূপ ড্রাগ ব্যবহার জনিত কারণে ব্যক্তির জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় তথা তাৎক্ষণিক ভাবে স্বাভাবিক বুদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ব্যক্তি বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে রাগের বর্হিঃপ্রকাশ করে থাকে।  

রাগ সৃষ্টির মনো সামাজিক কারণ সমূহ : ব্যক্তির মধ্যে রাগ বিভিন্ন মনো সামাজিক কারণে সৃষ্টি হতে পারে, তন্মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- (১) ব্যক্তিত্বের গঠনগত দুর্বলতা  (২) পরিবেশগত সমস্যা (৩) ব্যক্তির ঘুমের সমস্যা (৪) ব্যক্তির পরিবেশগত চাপ মোকাবেলার অক্ষমতা (৫) পরিবারগত আবেগীয় সমস্যা। (৬) পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেবার অক্ষমতা। (৭) ব্যক্তির বাসস্থানগত সমস্যা (৮) পরিস্থিতির হঠাৎ পরিবর্তনগত সমস্যা (৯) ব্যক্তির হতাশা। 

রাগের শারীরিক ক্ষতিসমূহ : রাগের কারণে ব্যক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি সমূহ বেড়ে যেতে পারে-(১) ব্যক্তির হার্ট এ্যাটাক ঝুঁকি বাড়তে পারে। (২) স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। (৩) ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। (৪) হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। (৫) বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো বা কখনো কখনো গা ঘামতে পারে। 

খাবার যা ব্যক্তির রাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে :  (১) ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার: প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ মাছ যেমন-মলা, ঢেলা গ্রহণের ফলে আমাদের জ্ঞানীয় কার্যাবলীর উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং এ জাতীয় খাবার খেলে ক্রমে ব্রেন ফ্যাংসান উন্নত হবে এবং আগ্রসী আচারণ দিনে দিনে দূর হবে। (২) কলা: কলাতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ভিটামিন-বি বিদ্যমান। এ দু’টি উপাদান স্নায়ু ব্যবস্থাকে শান্ত রাখে (৩) বাদাম ও বীজ: বাদাম ও বীজে প্রচুর পরিমাণে ট্রিফটোফ্র্যান, জিংক এবং সেলিনিয়াম বিদ্যমান যা ব্রেন ফ্যাংসানকে উন্নত করে। (৪) গ্রীণটি : কোন দিন মেজাজ খারাপ থাকার জন্য যদি কাজে বিঘœ ঘটতে থাকে তবে এক কাপ গ্রীণটি খান, দেখবেন মন অনেকটা ভাল হয়ে গেছে। (৫) ডার্ক চকলেট : ডার্ক চকলেট স্ট্রেস হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফিল্ড গুড হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায় যা মনকে শান্ত রাখতে সহায়তা করে।

রাগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী উপায় সমূহ : 

(১) গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন এবং ছাড়তে থাকুন: যখন কারোর উপর আপনি রেগে যাচ্ছেন, তখন গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন তিন সেকেন্ড দম আটকিয়ে রেখে তারপর আস্তে আস্তে দম ছাড়–ন, দেখবেন এতে রাগ অনেকটা কমে গেছে। 

(২) মনোযোগ সরিয়ে নিন: যখন বুঝবেন আপনি কারোর উপর কোন কারণে রেগে যাচ্ছেন, তখন মনকে সেই কারণ থেকে সরিয়ে অন্য কোন কাজে নিয়োজিত করে ব্যস্ত রাখুন। পছন্দের গান শুনুন বা মজার মজার ভিডিও দেখুন। 

(৩) নিয়মিত ব্যায়াম করুণ: প্রতিদিন সময় করে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ ও হতাশা দূর হয়। শারীরিক ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে সেরেটনিন ও এন্ডোফিন নামক উপাদান নিঃসৃত হয় যা সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে। 

(৪) উল্টো সংখ্যা গণনা শুরু করুন: যখন মনে হয় করোর উপর আপনার রাগ সৃষ্টি হচ্ছে, তখন আপনি ১০০ হতে উল্টা সংখ্যা গণনা শুরু করতে চেষ্টা করুন। এতে আপনার রাগ কমে যেতে পারে। 

(৫) পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান: যদি রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হয়, তবে সকালে মেজাজ খিট খিটে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমাতে হবে। আর ঘুম ভাল হলে ব্যক্তির মেজাজ ও ভাল থাকবে। 

পরিশেষে বলা যায়, রাগের পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধ্বংস বয়ে আনে। মনে রাখতে হবে -‘ভালবাসা ভালবাসা আনে আর রাগ বয়ে আনে ধ্বংস।’ 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে