খুলনা | শনিবার | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫ আশ্বিন ১৪৩০

ওয়াদা ভঙ্গ হতে বেঁচে থাকার উপায়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:৫৩ এ.এম | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২


ওয়াদা রক্ষার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি, বরং তিনি ছিলেন প্রতিশ্র“তি রক্ষার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল প্রতীক। নবীজি ওয়াদা করলে যেকোনো মূল্যে তা পালন করতেন। তিনি নিজের সঙ্গী-সাথিদের শত্র“র সঙ্গেও প্রতিশ্র“তি রক্ষার নির্দেশ দিতেন। রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের সিরাতে অঙ্গীকার রক্ষার অনুশীলন দেখুন, তাঁরা এমন এমন অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন, আজ তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু আনহু যিনি রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোপন কথা জানতেন। যখন তিনি ও তাঁর পিতা মুসলমান হয়ে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য মদীনায় যাচ্ছিলেন। অপর দিকে ইসলামের শত্র“ আবু জাহেল রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী নিয়ে মদীনায় যাচ্ছিল। পথিমধ্যে আবু জাহেলের সঙ্গে হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ফলে সে তাদের পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করল, কোথায় চাচ্ছ? তারা বললেন, আমরা মদীনায় রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে যাচ্ছি। একথা শুনে আবু জাহেল বলল, তাহলে তো তোমাদের ছাড়া হবে না। কারণ তোমরা মদীনায় গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করবে। তাঁরা বললেন, আমাদের উদ্দেশ্য হল শুধু রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও জিয়ারত। আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। আবু জাহেল বলল, তাহলে আমাদের সঙ্গে অঙ্গীকার কর যে, সেখানে গিয়ে শুধু মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। যুদ্ধে অংশ নেবে না। তাঁরা তার সঙ্গে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলেন। ফলে আবু জাহেল তাদের ছেড়ে দিল। যখন তাঁরা মদীনায় সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বদর যুদ্ধের জন্য রওনা হয়ে গিয়েছিলেন, যার কারণে রাস্তায় তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।
একটু ভেবে দেখুন, ইসলামের হক ও বাতিলের প্রথম লড়াই ‘বদর যুদ্ধ’। তা এমন যুদ্ধ যাকে কুরআনুল কারীমে  হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই যুদ্ধে যেই ব্যক্তিই অংশগ্রহণ করেছে তাকে ‘বদরী’ বলা হয়। সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বদরী সাহাবীদের অনেক সম্মান ও মর্যাদা ছিল। তাঁদের ব্যাপারে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সব আহলে বদর, যারাই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি জিহাদ সংগঠিত হওয়ার পথে যখন রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে হযরত হুযায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাক্ষাৎ হল। তখন তিনি প্রথমে রাস্তায় ঘটে যাওয়া পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিলেন, এ পথিমধ্যে আবু জাহেল আমাদেরকে আটক করেছিল। আমরা তার সঙ্গে এই অঙ্গীকার করে মুক্ত হয়েছি যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। তারপর তারা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বদর যুদ্ধ যেখানে আপনি তাশরীফ নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের অনেক ইচ্ছা আপনার সঙ্গে এই যুদ্ধে শরীক হতে। আর আবু জাহেলের সঙ্গে আমাদের অঙ্গীকার তা তো সে আমাদের গর্দানের উপর তরবারি রেখে আদায় করেছে যে, আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না। তার কথায় যদি আমরা সম্মত না হতাম, তাহলে সে আমাদের আটকিয়ে রাখত। সুতরাং হে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাদেরকে ইসলামের এই প্রথম জিহাদে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিন, যাতে আমরাও তার ফযীলত লাভে সৌভাগ্যবান হতে পারি। (আল-ইসাবা)
কিন্তু রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে তাদের বললেন, তোমরা এ যুদ্ধে শরীক হতে পারবে না। যেহেতু তোমরা তাদের সঙ্গে এই অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে এসেছ যে, এখানে শুধু আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না। ফলে এ শর্তের উপর তারা তোমাদের মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং তোমাদের যুদ্ধ অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয়া যাবে না। 
আর এটা হল এই স্থান যেখানে মানব জীবনের কঠিনতম এক পরীক্ষার মুহূর্ত। একজন মানুষ নিজের জবান, ওয়াদার প্রতি যতœবান। যদি আমাদের মত দুর্বল ঈমানের মানুষ হতেন, তাহলে হাজারো ব্যাখ্যা করে নিতেন। যেমন এমন ব্যাখ্যা করে নিতেন যে, তাদের সঙ্গে ওয়াদা খাঁটি মনে করিনি। তারা তো বলপ্রয়োগ ও জোরপূর্বকভাবে ওয়াদা নিয়েছে। আল্লাহ ভাল জানেন, এমন আর কত বাহানা খুঁজে বের করতাম। যেই ওজর ছিল, আর সময়ের দাবি হল রসূলের সঙ্গে জিহাদে শরীক হয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। যেহেতু মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা মাত্র তিনশ’ তেরজন ছিল। তাদের মাঝে আবার অনেকেই ছিলেন নিরস্ত্র। ফলে এই অবস্থায় প্রত্যেকটি মানুষের মূল্য অপরিসীম। যাদের কাছে মাত্র সত্তরটি উট, ছয়টি ঘোড়া, আটটি তরবারি অবশিষ্টদের কারো কাছে লাঠি, কারো কাছে পাথর ছিল। সাহবাদের এই ক্ষুদ্র দলটি এক হাজার কাফের যোদ্ধার মোকবেলা করতে যাচ্ছিলেন। তাই জনশক্তির খুব প্রয়োজন ছিল। এতকিছু সত্তে¡ও রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা যাবে না, সত্য হতে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। (ইসলাম আওর হামারী জিন্দেগী)
ওয়াদা রক্ষা করার সামর্থ্য থাকলে এবং তা পালন করতে ধর্মীয় কোনো বাঁধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা ওয়াজিব। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে ওয়াদা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে ওয়াদা দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
একজন আল্লাহওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে নেওয়া। তাঁর কাছে নিজের অন্তরের বিভিন্ন অবস্থাগুলো জানানো এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে সকল প্রকার ওয়াদা ভঙ্গ হতে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। (আমিন) 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ