খুলনা | শনিবার | ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

আতশবাজি না হয়ে, জ্বলতে চাই প্রতিদিনের প্রদীপ হয়ে...

পরিবারের বাধা ও মরণব্যাধি ক্যান্সারও দমাতে পারেনি নারী উদ্যোক্তা তানজিলার স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:১৩ এ.এম | ০১ অক্টোবর ২০২২


আমি একজন নারী। একজন মানুষ হিসেবে নিজ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই। শুধু নিজে নয় আরো দশজন নারীকে সাথে নিয়ে স্বনির্ভর হতে চাই। আমি একজন নারী উদ্যোক্তা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কতটা সফল হয়েছি বা ব্যর্থ হয়েছি তা জানিনা। আসল কথা হচ্ছে আমার যে কাজ ভালো লাগে, মন থেকে ভালোবেসে করতে পারি বা পারব সে কাজটাই আমি করি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করলে সে কাজ কখনো নিখুঁত বা সুন্দর হয় না। 
যখন ছোট ছিলাম স্কুলের স্যার জিজ্ঞেস করতেন তুমি পড়ালেখা করে কি হবে? বলতাম ডাক্তার হব, মানুষের সেবা করব। পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্তে¡ও গ্রামের পরিবেশে সায়েন্স (বিজ্ঞান) নিয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরেই বিয়ে হয়ে যায়। শত প্রতিকুলতা পেরিয়ে শ্বশুরবাড়ী থেকেই মাস্টার্স কমপ্লিট করি। পরে প্রশাসনে জব করার ইচ্ছা ছিলো তাও সম্ভব হয় না।
পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে ব্লক বাটিকের কাজ শিখি। তাছাড়া অনেক ছোট থেকেই দেখতাম আম্মা নিজের হাতে আমাদের জামা কাপড় তৈরি করে দিতেন। নিজের হাতে নকশিকাঁথা, পাখা, জামা ও শাড়ীতে ফুল তোলা সব করতেন। আমিও মায়ের কাছ থেকে সব শিখেছি। আর আমার জন্ম হস্তশিল্পের রাজধানী জামালপুরে। সব মিলিয়ে ছোট বেলা থেকেই আমার হাতের কাজের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা ও ভালোলাগা ছিলো।  খুব ছোট থেকেই যা দেখতাম নিজে নিজে তা তৈরি করে ফেলতাম। নিজের জামা কাপড় নিজে সেলাই করে পড়তাম ক্লাস ফোর এ পড়ি তখন থেকেই। নিজে ফুল একে জামায় সুই সূতার কাজ করতাম। আমার কাজের হাতে খড়ি মূলতঃ আম্মার কাছেই। তাছাড়া কাগজের মন্ড করে বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি, ফুলদানি ও অন্যান শো পিছ বানাতাম। চটের উপরে উলের সুতা দিয়ে জায়নামাজ টেবিলমাট কার্পেট সেলাই করতাম। উলের সোয়েটার, মাফলার তেরি করতাম। সিরিঞ্জ দিয়ে নকশি পিঠা, ফুলপিঠা বানাতাম। সেই সূত্রেই একজন উদ্যোক্তা হবার শখ । 
১. মাস্টার্স-এর রেজাল্টের পরেই একটা জবে জয়েন করি। কিন্তু  ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চাকুরির ২ বছরের মাথায় ক্যান্সার আক্রান্ত হই, মাত্র ২৭ বছর বয়সে। ক্যান্সারের চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে আর চাকুরিতে জয়েন করা হয় না। কারন ছেলেকে তখন দেখাশোনার কেউ ছিলো না। তখন একটা সেলাই মেশিন কিনি। বাচ্চার পড়ালেখা দেখাশোনার পাশাপাশি ২০০৭ সালে ব্লকের শাড়ী, থ্রি পিস, ফতুয়া ও বেডশিটের কাজ শুরু করি। ভালো সাড়াও পাই। কিন্তু ব্রেস্ট টিউমার অপারেশনের কারণে কাজ করতে একটু সমস্যা দেখা দিলো, তখন কাজটাও বন্ধ রাখি। 
২. ২০১৬ সাল আমি এবং আমার হাজব্যান্ড (স্বামী) মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কয়েকটা মেশিন কিনে নিজেদের ডিজাইনে গার্মেন্টসের কাজ শুরু করব। আমার হাজব্যান্ড বায়িং হাউজে জব করত। সে বিভিন্ন বায়ারের সাথে কাজ করত। ছেলে ও মেয়েদের প্যান্ট জ্যাকেট সে ডিজাইন করত আর স্যাম্পল তৈরি করত। তাই আমরা এমন প্লান করি। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। বিধি বাম। জুন থেকে অসুস্থ হয়ে সে (স্বামী) শয্যাশায়ী। দেশের বাইরে নিয়েও কিছু হলো না চিরবিদায় নিলেন আমাদের কাছ থেকে। 
৩. ছেলেকে নিয়ে রয়ে গেলাম আমি অথৈ সাগরের মাঝে। ছেলেও সবে মাত্র জেএসসি দিলো। সে আপসেট। কারো সাথে কথা বলে না। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। আমি নিঃসঙ্গ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকি। ভাইয়েরা আমার সংসার চালানোর খরচ দিতেন। কিন্তু নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আর পরনির্ভরশীলতা আমাকে গ্রাস করতে থাকে। চাকুরিতে জয়েন করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ছেলের কথা চিন্তা করে তাও করি না। এমনিতেই সে আপসেট, আমি পাশে না থাকলে ওর জীবনটা আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। পরনির্ভরশীলতা আমার কোনদিনই ভালো লাগতো না। কারো কাছে কিছু চাইতে পারতাম না কখনো। 
৪. তখন ফেসবুকেরও তেমন কিছু বুঝতাম না। আমার এক বন্ধুর পরামর্শে অনলাইনে বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেসব কাজ জানি তাই নিয়ে শুরু করি। সে ফেসবুক এ একটা পেইজ খুলে দিলো। তাতে আমার হাজব্যান্ডের ইচ্ছাটাও পূরণ হবে। কোথা থেকে প্রোডাক্ট সোর্সিং করব কোথায় কোন ধরনের পণ্য ও মেটেরিয়াল পাওয়া যাবে সেজন্য ২/৩টা মার্কেট ঘুরে দেখায়। আমি থাকি ঢাকায় আর আমার বন্ধু থাকে ঢাকার বাইরে। তাই সরাসরি কোনো কাজে সাহায্য করা ওর পক্ষে সম্ভব হয় না। পেইজের লোগো ডোমেইন হোস্টিং, ওয়েবসাইট এগুলো সে করে দেয় সব দেখাশোনা করে। 
৫. আমি ছেলেকে স্কুলে দিয়ে মার্কেট যাচাই ও পণ্য সোর্সিং করতে একা একা ঘুরে বেড়াই। প্রথম দিন আমার ফ্রেন্ড সাথে থেকে ২টা থ্রি পিছ কিনে আনি। তার মধ্যে একটা আমাকে গিফ্ট করে আর একটা আমার বোন নেয়। এভাবেই যাত্রা শুরু হলো ঞধহলরষধ'ং ঈড়ষষবপঃরড়হ এর।
৬. প্রথম অবস্থায় আমার পুঁজি মাত্র ৫০০০/ টাকা। তাই হোলসেলারদের কাছ থেকে ২/৩টা ড্রেস আর কিছু ছবি নিয়ে আসতাম। ছবি পোস্ট করে অর্ডার পেলে ড্রেস এনে কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দিতাম। এভাবে একটু একটু পরিচিত হলে কিছু টাকা পেইড করে কিছু বাকি রেখে মাল আনতাম। ২/১ দিন পর পর এভাবে প্রোডাক্ট আনতাম। এভাবে পুঁজি বাড়িয়ে ব্লকের বেডশিট, শাড়ী ও থ্রি পিছ কিছু করে করতে থাকি।
৭. প্রথমে কয়েকটা পার্সেল নিজেই ডেলিভারি করি। কারণ কোন কুরিয়ার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খোঁজ খবর নিয়ে রাসেল একটা কুরিয়ারে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়। আর ঢাকার বাহিরে সুন্দরবন আর এসএ পরিবহনে দেই। 
৮. প্রথমে আমার ভাবী ও বোনেরা উৎসাহিত দিলেও কিছুদিন পরেই আমার ভাইয়েরা বাধা হয়ে দাঁড়াল। আমি নাকি ফেরিওয়ালা। আমার ছেলের স্কুলের বন্ধুর মায়েরা বাসায় আসত তারাও নিতো। ২/৩ মাসের মধ্যে আলহামদুলিল­াহ! ভালো সাড়া পেলাম। ঢাকার বাইরেও আমার অনেক কাস্টমার তৈরি হলো। বিজনেসের ক্যাপিটাল বাড়তে লাগলো আলহামদুলিল­াহ! 
৯. কিন্তু পরিবারের লোকজনের কথায় মানসিকভাবে খুবই কষ্ট পাই, ভেঙে পড়ি হতাশা হয়ে পড়ি। একদিকে কাজের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে ব্যস্ততাও বাড়তে। অন্যদিকে পরিবার বিপক্ষে। অতিরিক্ত টেনশনে পড়ে যাই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আবারও  ক্যান্সার পজেটিভ হলাম সেকেন্ড স্টেজ। 
১০. আমার অপারেশন ও চিকিৎসা করার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। আব্বা-আম্মা, ভাই-ভাবী ও বোনদের আবদারে দ্বিতীয়বার ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হলো। অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। আলহামদুলিল­াহ এবারও আল­াহ সারিয়ে তুললেন। 
১১. হসপিটালের বিছানায় শুয়ে, ক্যানুলা হাত নিয়েও ড্রেসের অর্ডার নিয়েছি পার্সেল রেডি করেছি। ডেলিভারি দিয়েছি। কারণ কিছু কিছু ক্লায়েন্ট আছেন আমাকে খুবই বিশ্বাস আর ভরসা করে আমাকেই অর্ডার দিতেন। তাদের ভালোবাসা সত্যি আমি অভিভূত। অনেক ডাক্তার আপুরা আছেন আমার সম্মানিত রিপিট ক্রেতা। শুধু ঢাকা নয় সিলেট, চিটাগং, খুলনা, রাজশাহী ও ময়মনসিংহের অনেক ডাক্তার আপুরাও আমার ক্রেতা। দেড় বছরে আমার বিজনেসের পুঁজি হলো প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। আলহামদুলিল­াহ। এর মধ্যে ২টি খাট বানিয়েছি এবং বাসা পাল্টানোর সময় খরচ হয়েছে। আমার বাজার, ওষুধ ও বিভিন্ন ধরনের টেস্ট সব খরচ এখান থেকেই চলত। বাসা ভাড়া দিতো ভাইয়েরা।
১২. এই উদ্যোগটা আমার সন্তানের মত। আমার সন্তানকে আমি যতটুকু ভালোবাসি কেয়ার নেই। বিজনেসটাও ঠিক ততোটুকুই ভালোবাসি। 
১৩. করোনার সময় প্রায় এক বছর পেইজের কাজ বন্ধ থাকার মতোই ছিলো। তখন বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই সময় ২০২০ সালের জুন মাসে উই গ্র“পে জয়েন করি। সেখানে সবার পোস্ট পড়ে আরো উৎসাহিত হই। আবার সবার কথার অবাধ্য হয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করি। ২০২১ এর এপ্রিলে আম্মার অসুস্থতার জন্য আম্মার সাথে ছিলাম। রোজার সময় বাসায় চুরি হয়। আমার গহনা, ডিলারদের দেওয়ার জন্য টাকা ছিলো সব চুরি হয়ে যায়। মোটামুটি যা পুঁজি ছিলো সেখানে বড় একটা এমাউন্ট (টাকা) চলে যায়। অনেক বড় ধরনের লসে পড়ি। 
জুলাই মাসে বাসা শিফট করি। এখানেও অনেক টাকা খরচ হয়। বিজনেসটা স্টার্ট করতে করতে অনেক সময় লেগে যায়। এই নতুন বাসায়ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। চার তলায় বার বার ওঠানামায় সমস্যা শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া ইঁদুরের উৎপাতে কাপড় চোপড় রাখারও প্রবলেম শুরু হয়। ১ ফেব্র“য়ারি ২০২২ তারিখে আবার বাসা শিফট করি। ২০১৯ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২২ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত তিনবার বাসা শিফ্ট করি ছেলেকে নিয়ে। বাসার সব গুছিয়ে নিতে নিতে একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। ইচ্ছা, পরিশ্রম, ধের্য্য ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাআল­াহ! একদিন সবার ভুল ভাঙবে সেইদিনের অপেক্ষায়। “এখনো অনেক পথ বাকি যেতে হবে বহুদূর।”
১৪. আমার উদ্যোগের সিগনেচার পণ্য হচ্ছে ব্লক প্রিন্ট বেডশিট শাড়ী ও থ্রি পিস। অনেক সুনামের সাথে চলছে। খুব ভালো ফিডব্যাক পাচ্ছি আলহামদুলিল­াহ! শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও যাচ্ছে আমার ব্লক প্রিন্টের শাড়ী, পাঞ্জাবি ও বেডশিট। তাছাড়া আমার উদ্যোগের সিজনাল পণ্য খেজুরের গুড়ও চলে গেছে ফ্রান্স ও নিউইয়র্কে। ঘি, মধু ও সরিষার তেলের বেশ সুনাম আছে। এখন নতুন সংযোজন হয়েছে হ্যান্ডিক্রাফ্টের বিভিন্ন ধরনের  পণ্য। কিছু রিপিট ক্লায়েন্টদের ভালো ফিডব্যাক আছে আলহামদুলিল­াহ। ফেসবুক এ প্রায় ৫০০+ ক্লায়েন্ট আমার পণ্য ব্যবহার করেছেন। 
আমি আজ একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার কারনে আমার বাবার সমতুল্য বড় ভাই আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। কোনদিন খোঁজ খবর ও নেন না। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে কষ্ট পাই। কিন্তু হতাশা হই না। 
আমি মনে করি, আমি এখন সফলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু চার বছর যাবত টিকে আছি, আর পিছপা হবো না ইনশাআল­াহ।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ