খুলনা | রবিবার | ১৫ জুন ২০২৫ | ১ আষাঢ় ১৪৩২

কেমন ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সাঃ)

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০২:৩৭ এ.এম | ১৪ অক্টোবর ২০২২


একজন আমেরিকান অমুসলিম বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড্স’ বইতে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকা তৈরি করেছেন। তাতে সবার শীর্ষে যার নাম দিয়েছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল­াল­াহু আ’লাইহি ওয়া সাল­াম। আসলেই তিনি আদর্শের বিশ্বকোষ, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তার সম্পর্কে কথা বলতে গেলে হতে হয় নির্বাক, পৃথিবী হয় নিস্তব্ধ, কালি হয় নিঃশেষ, কলম হয় অচল। কল্যাণ ও আদর্শের কি ছিল না তার মধ্যে ! লাখো পৃষ্ঠাতেও সংকুলান হবে না তার আদর্শের কাহিনী। কারণ, মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল­াহতায়ালা তার প্রশংসায় বলেছেন, নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী (সূরা কলম:৪)। আর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আল­াহর রসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ (সূরা আহজাব: ২১)। তার কাছে এসে মিলিত হয়েছে আদর্শের সকল স্রোতধারা। 
বিনয় ও নম্রতা যার ভ‚ষণ: আল­াহর নবী (সাঃ) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র। তিনি এতই নরম প্রকৃতির ছিলেন যে মদীনার সাধারণ বাচ্চারাও তার হাত ধরে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিয়ে যেতে পারতো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও (রাঃ) মানুষের প্রতি নম্র আচরণের উপদেশ দিয়ে বলতেন, তোমরা নম্র ব্যবহার করো এবং কঠোর ব্যবহার করো না। মানুষকে শান্তি দাও এবং মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না (বুখারি: ৫৬৯৪)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একবার এক বেদুঈন মসজিদে প্রশাব করে দিলো। তখন লোকজন তাকে শাসন করার জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রাসূলুল­াহ (সাঃ) তাদের বললেনঃ তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রশাবের উপর পানি ঢেলে দাও। কারণ, তোমাদের নম্র ব্যবহারকারী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি (বুখারি: ৫৬৯৮)। 
ক্ষমা ও মহানুভবতার মূর্ত প্রতীক: ক্ষমা ও মহানুভবতা ছিল মহানবীর (সাঃ) সহজাত অভ্যাস।  প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনি চরম শত্র“কেও ক্ষমা করে দিতেন। মক্কার কাফির, মুশরিকরা হুজুরকে (সাঃ) প্রাণে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে, অত্যাচারের স্টীম-রোলার চালিয়ে তার উপর। তারপরও তিনি মক্কা বিজয়ের দিনে ঘোষণা করলেন, ‘হে কুরাইশরা! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা করো?’ তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মতো! তিনি বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আজ তোমরা মুক্ত!’ বিনা রক্তপাতের এমন বিজয়, আর বিজয়ের পরে সাধারণ ক্ষমার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবী কি কখনও দেখেছে ? এক ইহুদী বুড়ি তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিল, তারপরও তিনি তাকে মাফ করে দিয়েছিলেন। 
নিরহঙ্কার ও অনাড়ম্বতা যার পোশাক: রসূলের ভিতরে (সাঃ) অহংকারের লেশ মাত্র ছিলনা। তিনি সবার আগে মানুষকে সালাম দিতেন এবং বলতেন, যে আগে সালাম দেয় সে অহংকার মুক্ত। কিন্তু, বর্তমানে আমরা অপরের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকি; দেখি মুখ নড়ে কিনা, কখন সে আমাকে সালাম দেয়, এর পর উত্তর দিব। সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও তিনি বিলাসিতামুক্ত,অত্যন্ত সাটা-মাটা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। খেজুরের ছালভর্তি ছাটায়ের উপর শোয়ার কারণে তার পিঠে দাগ পড়ে যেতো। সাহাবারা (রাঃ) ভালো কোনো বিছানার ব্যবস্থা করার আবদার জানালে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলতেন, আমি দুনিয়াতে একজন পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে চলে যায় (তিরমিজি: ২৩৭৭)। তিনি সাহাবাদের সাথে এমনভাবে মিশে বসতেন যে, কোন আগন্তুক এসে চিনতে পারতো না কে আল­াহর রসূল। এ কারণে অধিকাংশ সময়ে তারা জিজ্ঞাসা করতো, তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ কে? 
লজ্জাশীলতা যার পর্দা: মানুষ অধিকাংশ সময়ে অশ্লীল ও বেহায়া কাজ করে শুধুমাত্র লজ্জাশীল না হওয়া কারণে। এক হাদিসে আছে, পূর্বেকার নবীদের কর্তব্য থেকে মানুষ যা বর্জন করেছে তার একটি হল লজ্জা, যদি তুমি লজ্জাই ছেড়ে দাও তবে তুমি যা চাও তা কর (বুখারি:৫৬৯০)। বিশিষ্ট সাহাবি আবু সাঈদ (রাঃ) বলেনঃ নবী (সাঃ) নিজ গৃহে অবস্থানরত কুমারী মেয়েদের চেয়েও বেশী লাজুক ছিলেন (বুখারি: ৫৬৮৯)। আজ আমাদের সমাজের চারদিকে, বিশেষ করে যুবক-যুবতী যে সমস্ত নির্লজ্জ কাজ করে তা আবার সোশ্যাল মিডিয়ার ছেড়ে দিচ্ছে তা লিখতেও ঘৃণাবোধ হয়। রসূলের (সাঃ) শিক্ষাই পারে এই বিপথগামী যুবকদের বাঁচাতে।
মিশুক এক নবী: সকল রসূলের সেরা হয়েও মহানবী (সাঃ) ছোট-বড়, শিশু-বৃদ্ধ সবার সাথে মন খুলে মিশতেন।  আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, আমাদের সাথে নবীজি (সাঃ) মেলামেশা করতেন, এমনকি একদিন তিনি আমার এক ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ওহে আবু উমায়রা, তোমার নুগায়র পাখিটি কেমন আছে (বুখারি: ৫৬৯৯)? আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবীজির (সাঃ) সামনেই আমি (ছোট বেলায়) পুতুল বানিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবীরাও আমার সঙ্গে খেলতো। আল­াহর রসূল (সাঃ) ঘরে প্রবেশ করলে তারা দৌঁড়ে পালাতো। তখন তিনি তাদের ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন এবং তারা আমার সঙ্গে খেলা করত (বুখারি:৫৭০০)।
দানশীলতা যার মজ্জাগত: আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবীজি (সাঃ) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবার চাইতে অধিক দানশীল এবং লোকদের মধ্যে সর্বাধিক সাহসী ছিলেন (বুখারি:৫৬০৭)। কেউ কিছু চাইলে তিনি তাদেরকে খালি হাতে ফেরাতেন না। জাবির (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর নিকট এমন কোন জিনিসই চাওয়া হয়নি, যার উত্তরে তিনি ‘না’ বলেছেন (বুখারি:৫৬০৮)।
গরীবের বন্ধু, নিঃস্ব’র আশ্রয়স্থল : নিঃস্ব, অসহায় ও এতিমদের প্রতি দয়ার শেষ ছিলনা মহানবী (সাঃ) এর। কিভাবে গরীব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায় এই জন্য সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তিনি তাদেরকে খুব ভালোবাসতেন এবং সাহাবাদেরকেও ভালোবাসা ও দয়ার হাত প্রসারিত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে বলতেন, যদি কোন ব্যক্তি কোন বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করে আল­াহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরিধান করাবেন। যদি কেউ কোন ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়ায় আল­াহপাক তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর যদি কেউ কোন  পিপাসিতকে পানি পান করায় মহান আল­াহপাক তাকে জান্নাতের মোহরযুক্ত পানীয় পান করাবেন (আবু দাউদ, তিরমিজী)। আর এক হাদিসে নবীজি (সাঃ) এরশাদ করেন, আমি ও এতিমের তত্ত¡াবধানকারী জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকবো। এ কথা বলার সময় তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল মিলিয়ে ইশারা করে দেখান (বুখারী:৫৫৭৯, তিরমিজী:১৯১৮)। 
বিধর্মীদের প্রতি সদাচরণ: কেবল মুসলমানই নয়, অমুসলিমদের সাথে মহানবী (সাঃ) যে উত্তম আচরণ দেখিয়েছেন, তা আজও সবাইকে বিস্মিত করে। কোন অমুসলিম নাগরিকের প্রতি যদি কোন জুলুম করা হয় তাহলে নবীজি (সাঃ) স্বয়ং নিজে তার বিরুদ্ধে বিচারের দিনে দাঁড়াবেন বলে উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছেন। একবার এক ইহুদি নবীকে মারতে এসে তার মেহমান বনে গেলো। রাতে রসূল (সাঃ) যথাসাধ্য আপ্যায়ন করে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু শয়ন কক্ষে বিছানায় সেই ইহুদি লোকটি পায়খানা করে চলে গেলো। সকালে হুজুর (সাঃ) তার কোনো সন্ধান পেলেন না। রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা মুবারক মলিন হয়ে গেলো। আফসোস আর আক্ষেপ করে বলতেছিলেন, ‘হায়! আমি বুঝি তার যথাসাধ্য আপ্যায়ন করতে পারিনি’। হুজুর (সাঃ) নিজ হাতে সে পায়খানা পরিস্কার করলেন। 
মহানবীর চরিত্র ও আদর্শের কথা লিখে কখনও শেষ করা যাবে না। তিনি মানবতার জীবন্ত মডেল। তাই আসুন, আমরা মহান নবীর মহান আদর্শকে অনুসরণ করি এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তার আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়ে এক সুস্থ সমাজ গড়ি।  
লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ।

্রিন্ট

আরও সংবদ

ইসলাম

প্রায় ১১ দিন আগে