খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

মানসিক স্বাস্থ্য সংকট ও করণীয়

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী |
০১:৪১ এ.এম | ২২ অক্টোবর ২০২২


মানুষ মাত্রই সুস্থ দেহ ও মনের প্রত্যাশী। সুস্থ দেহ ও মনের স্বাভাবিক প্রভাবকে কেন্দ্র করে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা প্রবাহিত। পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপকের সঙ্গে মনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে আমাদের মন কখনো কখনো উৎফুল­ আবার কখনো দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুস্থ মনের উৎফুল­তা মানুষকে যেমন সুন্দরভাবে বাঁচতে সহায়তা করে। তেমনই অসুস্থ মনের বিষময়তা জীবনকে বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিপত্তি ঘটে তখনই যখন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্য মানে ব্যক্তির আবেগীয়, মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা। আমরা কি ভাবে চিন্তা করি, অনুভব করি এবং কোন পরিস্থিতিকে কিভাবে মোকাবেলা করি- এরূপ সব কিছুই মানসিক স্বাস্থ্যকে নির্দেশ করে। শিশু বয়স হতে যৌবন বয়স, যৌবন হতে বৃদ্ধ বয়স-জীবনের এরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলতঃ ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে সুস্থ ও সুখ- স¦াচ্ছন্দ্য বোধ করার মানসিক ও শারীরিক অবস্থাকে মানসিক সুস্বাস্থ্য বলে অভিহিত করা হয়।
ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতাজনিত লক্ষণ সমূহ : ব্যক্তির- (১) খুব উদ্বিগ্নতা বা ভীতিবোধ করা, (২) খুব  দুঃখ বা আশাহীনতা অনুভব করা, (৩) চিন্তা ও শিক্ষণে ত্র“টি দেখা দেওয়া বা মনোযোগ সমস্যা দেখা দেওয়া, (৪) অস্বাভাবিকভাবে মেজাজের পরিবর্তন সূচিত হওয়া, (৫) দীর্ঘমেয়াদী রাগ বা খিটখিটে মেজাজের অনুভূতি হওয়া, (৬) বন্ধুদের সঙ্গ ও সামাজিক সম্পর্ক ত্যাগ করা, (৭) ঘুমের অনুসূচিতে পরিবর্তন আসা এবং ক্লান্তি অনুভব করা, (৮) খাবার গ্রহণের অনুসূচীতে পরিবর্তন আসা এবং ক্ষুধা কমে যাওয়া বা ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া, (৯) যৌন চাহিদা কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, (১০) আবেগ, অনুভূতি বা বিশ্বাসে পরিবর্তন আসা বা অন্যের আবেগ, অনুভূতি বুঝতে অক্ষম হওয়া, (১১) ব্যক্তির ভিতর আত্মহত্যার চিন্তার উদ্রেক হওয়া, (১২) নিত্য দিনের কার্যসমূহ সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হওয়া;
বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের লক্ষণ : (১) বিদ্যালয়ের পারফরম্যান্সে পরিবর্তন তথা নেতিবাচক মান দেখা দেওয়া, (২) অতিরিক্ত উদ্বেগ্নতা যা তাকে ঘুমাতে সমস্যা সৃষ্টি করে, (৩) রাতে দুঃস্বপ্ন দেখা এবং ঘুম ভেঙে যাওয়া, (৪) আচরণের স্বাভাবিকতা লুপ্ত হওয়া, (৫) রাতে বিছানায় প্রস্রাব করা, (৬) বার বার রাগ দেখানো, (৭) বড়দের প্রতি অমান্যসূচক আচরণ প্রদর্শন ইত্যাদি লক্ষণ সমূহ বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটকে নির্দেশ করে।
মানসিক নির্যাতন বা অসুস্থতার প্রভাব : (১) ব্যক্তির মধ্যে গুরুতর আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়, (২) নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে ব্যক্তির মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, (৩) এসব ব্যক্তি সব সময় ভয়ে ভয়ে জীবনযাপন করে, (৪) ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, (৫) অনেক ক্ষেত্রে এরা পরিস্থিতিকে মানিয়ে চলতে ভয় পায়, (৬) এরা পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে কোন কাজ করতে ব্যর্থ হয়, (৭) পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে এদের আবেগজনিত আচরণের ঘাটতি দেখা দেয়, (৮) অন্যকে পাত্তা না দেওয়ার একটি মানসিকতা এদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে, (৯) অন্যকে বিনা কারণে দোষ দেওয়ার একটা প্রবণতা এদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে, (১০) পারিবারিক জীবনে এরা সুউপযোজন হতে ব্যর্থ হয়, (১১) মানসিক স্বাস্থ্যের খারাপ পরিণতিতে ধীরে ধীরে এদের মধ্যে আতঙ্ক, হতাশা এবং উদ্বেগ বিকাশ লাভ করে। 
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খাদ্যের প্রভাব : গবেষণায় দেখা গেছে ,ওমেগা থ্রি ফ্যাটিএসিড সমৃদ্ধ খাবার আমাদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, রোগির খাদ্যে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত চিনি থাকলে বিভিন্ন মানসিক রোগ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ভিটামিন বি টুয়েলভ সমৃদ্ধ খাদ্য আমাদের মানসিক অবসাদ, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ও হতাশাকে দূর করে। গবেষণায়ও দেখা গেছে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বীজ মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারি। 
মানসিক স্বাস্থ্যহীনতা ও শারীরিক প্রভাব : যেহেতু মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিরা প্রায় উদ্বেগ, ভয়, হতাশা, ভ্রান্ত বিশ্বাস ইত্যাদি দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয়, তাই তারা বিভিন্ন শারীরিক ঝুঁকিতে থাকে। তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হার্টে সমস্যা, মাথা ঘোরা, পেটে পীড়াজনিত সমস্যা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি সমস্যা প্রায় দেখা যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার উপায় : (১) বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা, (২) পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে সবার সাথে সদ্ভাব ও সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করা, (৩) এমন কিছু কাজের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যা ব্যক্তিকে আনন্দ দেয় এবং আত্মবিশ্বাস যোগায় যেমন- শখের বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি, (৪) ভাল লাগার মুহূর্তগুলো পরিবারের সদস্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, (৫) গৃহে অবস্থানকালীন সময়ে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা, (৬) বাইরে আপনার যতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্য ততটুকুই আন্তরিকতার সাথে পালন করার চেষ্টা করা। অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মানসিক চাপ না বাড়ানোই উত্তম, (৭) পরিবারের সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও তাদের কথাগুলো গুরুত্বের সাথে শোনার অভ্যাস তৈরি করা এবং সকল আবদারের সমাধান দিতে না পারলেও বুঝিয়ে ব্যাপারটি মীমাংসা করার চেষ্টা করা, (৮) অযথা অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা, (৯) কোন কাজ একশ’ ভাগ নির্ভুলভাবে সমাধান করার মানসিকতাকে পরিহার করা কারণ প্রত্যাশার সাথে আমাদের মানসিক যোগাযোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে ক্ষেত্রে কাজটি সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে সমাধান না হলে মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, (১১) শারীরিক ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত করে যা আমাদের মনকে প্রফুল­ রাখে ও মানসিক স্বাস্থ্যকে সবল রাখে। তাই প্রতিদিন প্রায় এক ঘন্টা ব্যায়াম করা উচিৎ। 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা। 
Email:[email protected]

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে