খুলনা | সোমবার | ১৯ মে ২০২৫ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গীবত

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:৪৫ এ.এম | ২৯ অক্টোবর ২০২২


একদিনের ঘটনা কোনো প্রয়োজনে একজন মহিলা রসূলুল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের খেদমতে উপস্থিত হলেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল­াহু আনহা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রয়োজন শেষ হলে মহিলা চলে গেলেন। সরল মনা মানুষ ছিলেন হযরত আয়েশা রাদিয়াল­াহু আনহা। তিনি রসূলুল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের নিকট সরল চিত্তে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলুল­াহ্ মহিলাটি কি বেটে আকৃতির নয়। হযরত আয়েশা রাদিয়াল­াহু আনহার এই কথা শুনে রসূলুল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের চেহারা রক্তিম হয়ে গেল। রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম হযরত আয়েশা রাদিয়াল­াহু আনহাকে বললেন, ‘হে আয়েশা তুমি ঐ মহিলাটির গীবত করলে! তুমি এমন কথা বললে যা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে সমুদ্রের পানির রং পরিবর্তন হয়ে কালো হয়ে যেত। আয়েশা রাদিয়াল­াহু আনহা বললেন তার বেঁটে হওয়ার কথাই তো বলছি এবং এই ত্র“টিতো তার মধ্যে রয়েছে। রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম বললেন, হে আয়েশা যদিও তুমি সত্য কথা বলেছো কিন্তু তুমি তার ত্র“টি বর্ণনা করায় তা গীবত তথা পরনিন্দা হয়ে গেল।’
শরী‘আতের পরিভাষায় গীবত হচ্ছে, ‘কারো অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষের কথা আলোচনা করা যা সে গোপন রেখেছে অথবা যার উলে­খ সে অপছন্দ করে।’
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল­াহু আনহু থেকে বর্ণিত একদিন রসূলুল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম সাহাবাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি বলতে পার গীবত কাকে বলে? সাহাবিগণ বললেন, আল­াহ ও তাঁর রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম-ই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার কোনো ভাই (দ্বীনি) সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল­াহর রসূল, আমি যে দোষের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? উত্তরে রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি অবশ্যই তার গীবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ। (মুসলিম)
ইমাম গাযযালী রহমাতুল­াহি আলাইহি বলেন, গীবত হচ্ছে তুমি তোমার ভাইয়ের দোষ ত্র“টি এমনভাবে উলে­খ করলে যে, তা যদি তার কানে পৌঁছে তবে সে তা অপছন্দ করবে।
ইবনুল আছীর রহমাতুল­াহি আলাইহির মতে, কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দুর্নাম করা, যদিও তার মধ্যে সেই দোষ থেকে থাকে তাই গীবত। 
ইমাম নববী রহমাতুল­াহি আলাইহির মতে, কোন ব্যক্তিকে এমনভাবে উলে­খ করা যা সে অপছন্দ করে তা প্রকাশ্যে হোক বা ইশারা ইঙ্গিতে হোক, তাই গীবত।
বস্তুত, বাচনিক অথবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রতঙ্গের ইশারা ইঙ্গিতে কিংবা অন্য যে কোন উপায়ে কোন মুসলমান অথবা অমুসলিম, জীবিত বা মৃত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন কোন দোষ-ত্র“টি বর্ণনা করা যা সে গোপন রেখেছে অথবা যার উলে­খ সে অপছন্দ করে তাকে গীবত বা পরনিন্দা বলে। যদি এমন কোন দোষ-ত্র“টির আলোচনা করা হয়, যা ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় না, তবে তা বুহতান বা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে।
গীবত ইসলামি শরী’আতে হারাম ও কবিরা গুণাহের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের আশে পাশে আজ এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে কম-বেশি এই গীবতের চর্চা হয় না। ঘরের ভিতরে-বাইরে, পাশের বাসার ভাবির সাথে গল্পগুজবে, চায়ের আসরে, ক্লাসের ব্রেকে, বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, যে কোনো অনুষ্ঠানে, অফিসে কাজের ফাঁকে, খেলাধুলা থেকে শুরু করে স্বাভাবিক আলাপচারিতায়। এছাড়াও আমরা আবিদ, আলিম, জাকির, দায়ী ধর্মপ্রাণ মানুষও এই কঠিন বিধ্বংসী পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। যে কোনো আলোচনায় কেউ কারো নামে কোন কিছু একটা বললেই হয়েছে, এরপর শুরু হয় গীবতদের মজাদার আসর। অনেকটা বৃষ্টি মুখর পরিবেশে চানাচুর মুড়ির মত। এর কারণ গীবত যে একটি জঘন্য গোনাহের কাজ এ কথাটি আমাদের অনেকেরই জানা নেই আর যাদের জানা আছে তারা বিষয়টি ঐভাবে অনুধাবন করি না। এক্ষেত্রে আমরা এটাই মনে করি যে, গীবত আর তেমন কি গুণাহ, যা বলছি সেটা তো সত্য কথাই বলছি। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। 
গীবত দ্বারা পারস্পরিক ভালবাসা, মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়। সামাজিক জীবনে ঘৃণা, হিংসা ও শত্র“তার উন্মেষ ঘটে ফলে পরস্পরের মাঝে বিবাদ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোন্দল ও মারামারি পর্যন্ত সংঘটিত হয়। আর এ ধরণের লোককে মানুষ অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। গীবত করার দ্বারা চেহারার নুর চলে যায়। গীবত করার সঙ্গে সঙ্গে দিলের মধ্যে এমন যুলমত ও অন্ধকার সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা মানসিক কষ্ট হয়। যেন কেউ অন্তরের মধ্যে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত করে ফেলেছে। যার দিলের মধ্যে সামান্য অনুভব-অনুভূতিও রয়েছে, সে এই ক্ষতিটা অনুধাবন ও উপলব্ধি করে। যে ব্যক্তি সব সময় গীবতে লিপ্ত থাকে তার দু’আ কবুল হয় না। কেননা সে খুবই কম অনুতপ্ত হয়। গীবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না। গীবতকারীর আমলনামায় পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে। গীবতকারীর নেকআমল যার গীবত করা হয়েছে তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। যদি তাতে কমি পুরা না হয়, তা হলে যার গীবত করা হয়েছে তার গুণাহ ও বদআমল গীবতকারীর গরদানে চাপিয়ে দেওয়া হয়। 
পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল­াহ তা’য়ালা গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন, কুরআনের ভাষা, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো’। (সূরা হুজুরাত; ১২)
গীবতের ভয়াবহতার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিসে উলে­খ করা হয়েছে। রসূল সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ইরশাদ করেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারী ও মুসলিম) আরেক হাদীসে এসেছে, ‘তোমরা গীবত করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, গীবতের মাঝে তিনটি ক্ষতি রয়েছে: ১. গীবতকারীর দোয়া কবুল হয় না। ২. গীবতকারীর কোনো নেক আমল কবুল হয় না। ৩. আমলনামায় তার পাপ বৃদ্ধি হতে থাকে।’
আল­াহই সর্বজ্ঞ। মহান আল­াহ তা’য়ালা আমাদেরকে গীবতের মত লাগামহীন এই গুণাহর ভয়াবহতা ও কদর্যতা উপলব্ধি করে এ থেকে বাঁচার উপায়সমূহের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন) 
সংকলক: লেখক ও গবেষক।

্রিন্ট