খুলনা | সোমবার | ১২ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

বিনা চিকিৎসায় ৩ রোগী মৃত্যুর অভিযোগ স্বজনদের : জখমের মামলা ডাঃ নিশাতের : শ্লীলতাহানী চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ পত্নীর মামলা

খুলনায় চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:২২ এ.এম | ০২ মার্চ ২০২৩


চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ফলে বিভাগীয় শহর খুলনায় ভেঙে পড়েছে চিকিৎসা সেবা। কর্মবিরতির প্রথমদিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ১২ ঘন্টায় বিনাচিকিৎসায় তিন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে সাংগঠনিকভাবে কর্মসূচি ঘোষণায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দাবি নাগরিক নেতাদের। চিকিৎসক সংগঠনের পক্ষ থেকে ডাকা হয়েছে কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচি, যা অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে করে খুলনা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আগত রোগীদের নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন স্বজনরা। বিএমএ খুলনার ডাকা কর্মবিরতির ফলে গতকাল বুধবার সকাল থেকে চিকিৎসাসেবায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
সূত্রমতে, নগরীর শেখপাড়া হক নার্সিং হোম নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে গত ২৫ ফেব্র“য়ারি রাত ১১টার দিকে সৃষ্ট অপ্রীতিকর ঘটনাকে ঘিরে বিএমএ খুলনার থেকে কর্মবিরতি আহŸান করা হয়। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও দায়ের হয়েছে। গতকাল বুধবার খুলনার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের পালন করা হয় সেই কর্মসূচি। এরপর রাতে বিএমএ’র কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
পাল্টাপাল্টি মামলা : শ্লীলতাহানি ও শিশুর অঙ্গহানীর অভিযোগে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বুধবার দুপুরে নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন পুলিশ পতœী ভুক্তভোগী নুসরাত আরা ময়না। এতে  ডাঃ নিশাত আব্দুল­াহ ও হক নার্সিং হোমের মালিক ডাঃ নুরুল হক ফকিরকে আসামি করা হয়।  
এর আগে হামলার অভিযোগে গত মঙ্গলবার শহিদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিশাত আব্দুল­াহ বাদী হয়ে নুসরাত আরা ময়নার স্বামী পুলিশের এএসআই নাইম শেখের বিরুদ্ধে একই থানায় মামলা করেন।  
মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী নুসরাত আরা ময়না উলে­খ করেন, তার স্বামী চাকুরির সুবাদে সাতক্ষীরাতেই অবস্থান করেন। তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ডাঃ নিশাত আব্দুল­াহকে দেখালে তিনি মেয়ের হাতের আঙুলের অপারেশন করানোর কথা বলেন। তিনি আবু নাসের হাসপাতালে অপারেশন না করিয়ে তার পরিচিত ময়লাপোতা হক নার্সিং হোম থেকে অপারেশন করালে ভালো হবে বলে জানান। কারণ তিনি হক নার্সিং হোমে রোগী দেখেন ও অপারেশন করেন। 
তার কথা অনুযায়ী গত ১৭ জানুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে আমার মেয়েকে অপারেশন করানোর জন্য নগরীর শেখপাড়ার হক নার্সিং হোমে ভর্তি করান। ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ডাঃ নিশাত তার মেয়ের হাতের আঙুল অপারেশন করেন। অপারেশন করার পর থেকে দিন দিন আমার মেয়ের হাতের আঙুল কালো হতে থাকে। এ বিষয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে তিনি তার মেয়ের আঙুলের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে দিতে বলেন। আমি তার কথা অনুযায়ী সরল বিশ্বাসে তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেয়ের আঙুলের ছবি পাঠাই। পরবর্তীতে সে তার মেয়ের চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য তার ব্যবহৃত মোবাইলে নম্বরে বিভিন্ন সময় তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে কল করে। তার মোবাইল নম্বরে তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে গত ১১ ফেব্র“য়ারি রাত ১২টা ৩২ মিনিটে ‘ঘুম?’ রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে ‘রাগ?’ রাত ১২টা ৩৮ মিনিটে ‘কথা বলা যাবে?’সহ বিভিন্ন সময় আপত্তিকর বার্তা প্রেরণ করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় ফোন করে তাকে একা দেখা করতে বলেন। তার মেয়ের সুচিকিৎসার কথা চিন্তা করে চিকিৎসকের মোবাইলের কল ও ম্যাসেজের বিষয়ে কাউকে কিছু জানাইনি।
তিনি আরও উলে­খ করেন, গত ৬ ফেব্র“য়ারি তার মেয়েকে নিয়ে শেখপাড়া হক নার্সিং হোমের চেম্বারে ড্রেসিং করানোর জন্য যেতে বলেন। সন্ধ্যায় সেখানে গেলেও তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। রাত সাড়ে ৮টায় তার মেয়েকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে গেলে নিশাত আবদুল­াহ আমাকে বিভিন্ন প্রকার আপত্তিকর কথাবার্তা বলার একপর্যায়ে আমার হাত ধরে টেনে তার কাছে নেয়ার চেষ্টা করেন। তার কু-মতলব বুঝতে পেরে মেয়েকে নিয়ে তিনি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসি। বিষয়টি ক্লিনিক মালিককে জানালে তিনি ডাঃ নিশাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে কাউকে কিছু না বলার জন্য শাসান।
এজাহারে বলা হয়, গত ২৩ ফেব্র“য়ারি আবু নাসের হাসপাতালে ওই ডাক্তারের কাছে গেলে তার নির্দেশে হাসপাতালে থাকা ফিজিও থেরাপিস্ট লিপি নামে একজন আমার মেয়ের হাতের আঙুল ড্রেসিং করে দেন। পরে গত ২৫ ফেব্র“য়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার মেয়ের হাতের আঙুল ব্যান্ডেজসহ খুলে পড়ে গেলে ডাক্তার নিশাতকে ফোনে জানাই ও হক নাসিং হোমে যাই। সেখানে আমার মেয়ের চিকিৎসা করতে অনীহা প্রকাশ করেন ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন রকম কথাবার্তা বলেন। তখন আমি ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানালে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হলে আমার মেয়ে আঙুল ব্যান্ডেজ করে দেন। আমার ওপর অসৎ উদ্দেশ্যে চরিতার্থ করতে না পেরে অন্য আসামিদের পরস্পর যোগসাজসে আমার মেয়ে অথৈয়ের (৬) বাম হাতের আঙুলে গুরুতর আঘাত দিয়ে আঙুল স্থায়ীভাবে বিকলাঙ্গ করে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন।  
ডাঃ শেখ নিশাতের মামলা : গত মঙ্গলবার ডাঃ শেখ নিশাত আব্দুল­াহ মামলার এজাহারে উলে­খ করেন গত ২৫ ফেব্র“য়ারি রাতে নগরীর শেখপাড়ার হক নার্সিং হোমে একজন রোগীর সার্জারি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। জটিল অপারেশন বিধায় দীর্ঘ সময় অপারেশন চলছিল। রাত ১০টায় সাতক্ষীরা পুলিশ বিভাগে কর্মরত এএসআই নাঈম ও তার স্ত্রী ৪/৫ জন লোক নিয়ে আমার অপারেশন থিয়েটারের দরজায় লাথি মারা শুরু করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন-আমার মেয়ে অথৈকে এক মাস আগে আঙুল অপারেশন করেছিলি, আমার মেয়ের আঙুল ভালো হয়নি। এর জন্য তুই দায়ী। এখনই ১০ লাখ টাকা আমার মেয়ের ক্ষতিপূরণ দিবি। এরপর এএসআই নাঈম আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিলঘুষি লাথি মারতে থাকেন। এ সময় তার স্ত্রী ও সঙ্গীরা আমাকে ঘিরে রাখেন। একপর্যায়ে এএসআই নাঈম গলা টিপে ধরে তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় তার স্ত্রী তার দু’হাত চেপে ধরেন এবং অন্য অজ্ঞাতনামারা ডাক্তারকে মারপিট করতে থাকেন, তারা ক্লিনিকের ওটিতে ভাঙচুরও চালান। একপর্যায়ে তার সঙ্গে থাকা নার্সসহ অন্য সহযোগীরা এবং ক্লিনিকের মালিক ডাঃ নুরুল হক ফকির দৌড়ে এসে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেন। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থতার কারণে বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে সোনাডাঙ্গা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মমতাজুল হক বলেন, উভয়পক্ষ থানায় মামলা করেছে। বুধবার ভুক্তভোগী ওই নারী বাদী হয়ে শ্লীলতাহানী ও শিশুর অঙ্গহানীর অভিযোগ তুলে ডাঃ নিশাত আব্দুল­াহ ও হক নার্সিং হোমের মালিক ডাঃ নুরুল হক ফকিরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।  এর আগে মঙ্গলবার ডাঃ নিশাত আব্দুল­াহ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। দু’টি মামলার আসামিকেই গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে, পাশাপাশি ঘটনার তদন্ত সু²ভাবে করা হচ্ছে। 
রোগীর মৃত্যু : বিএমএ খুলনার ২৪ ঘন্টা কর্মবিরতির প্রথমদিনে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২ ঘন্টায় বিনা চিকিৎসায় তিন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলছেন স্বজনরা। পরবর্তী ১২ ঘন্টায় মুমূর্ষু রোগীর জীবন নিয়ে রোগীর স্বজনেরা শঙ্কিত।
গতকাল বুধবার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী ৯-১০ ওয়ার্ডে দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনীমহল গ্রামের লিটন (৫০) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একই দিনে ১১-১২নং ওয়ার্ডে ঝিনাইদহের মহেশপুর এলাকার ফকিরচাঁদের ছেলে জয়নালের মৃত্যু হয়েছে। তিনি প্রসাবের সাথে রক্তপড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন। তারপরেই ৭-৯নং ওয়ার্ডে কুলসুম বেগম নামে আরেক রোগীর মৃত্যু হয়। তিনি শ^াসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি নগরীর ইকবালনগর এলাকায় ভাড়া থাকতেন। 
রোগীর স্বজনরা দাবি করেন, তাদের মুমূর্ষু রোগীকে জরুরি সেবা না দিলে তাদের প্রাণ যেতে পারে। তারা বলেন, চিকিৎসকরা একের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে পবিত্র পেশার অমর্যাদা করছেন।
অন্যদিকে গতকাল বিকেলে বিএমএ মিলনায়তনে চিকিৎসকদের এক জরুরি সভা বসে। সভা শেষে বিএমএ খুলনা শাখার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আসামি এএসআই নাঈম গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
তারা আজ বৃহস্পতিবার পৌনে ১০টায় খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। পরে বেলা ১১টায় শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিষয়টি নিয়ে খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, চিকিৎসকদের সাথে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে এটা কারও কাম্য নয়। একই সাথে চিকিৎসকদের প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন হওয়া উচিৎ। তারা মহান পেশার দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ রোগীদের কষ্ট দেয়া অবশ্যই ঠিক নয়।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ রবিউল হাসান বলেন, বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ আমাদের ইনডোর সার্ভিস চালু ছিল, বন্ধ ছিল শুধুমাত্র আউটডোর। রোগী প্রতিদিনই মারা যায়, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে বিনাচিকিৎসায় বা ডাক্তার না পাওয়ার কারণে কোন রোগী মারা যাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।

্রিন্ট

আরও সংবদ