খুলনা | শুক্রবার | ৩১ মার্চ ২০২৩ | ১৬ চৈত্র ১৪২৯

ক্ষমা ও বরকতের রাত শবে বরাত

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৫৪ এ.এম | ০৭ মার্চ ২০২৩
শবে বরাতের ইসলামী ভিত্তি কি? অনেকে সম্প্রতি বলছেন, শবে বরাত বলে কিছু নেই। আবার আমাদের দেশে শবে বরাতের একটি রূপ হলো, বিশেষ বিশেষ প্রোগ্রামের আয়োজন করা, হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করা, কবরখানায় আলোকসজ্জা করা, কবরগুলো ফুল দ্বারা সাজানো ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কুরআন-হাদিসের ভাষায় শবেবরাত কি? ফারসি ‘শব’ অর্থ রাত, আর আরবী ‘বারাআত’ অর্থ মুক্তি। সুতরাং, শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। হাদিসের বর্ণনায় এটা হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’-অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত। শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য মানুষকে মাফ করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। এ কারণে এই রাতকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনী বলা হয়। সুতরাং দেখা যায়, নাম ভিন্ন হলেও শবে বরাত সহীহ হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষ রয়েছে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত। তারা এ রাতকে উপলক্ষ্য বানিয়ে নানা অনৈসলামিক কাজকর্ম ও রসম-রেওয়াজে থাকে ব্যস্ত। হক্কানি উলামায়ে কেরাম সবসময়ই এসবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনও করছেন। আমাদের দেশে শবে বরাত বলতেই ভেসে ওঠে হালুয়া-রুটির এক দৃশ্য। কবরে চলে নানা রকম আলোকসজ্জা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন। অনেক স্থানে মাজারগুলো পরিণত হয় শিরক-বেদায়াতের আখড়ায়। হালুয়া আরবি শব্দ, অর্থ হলো মিষ্টি বা মিষ্টান্ন। রাসূলুল্লাহ (স.) মিষ্টি পছন্দ করতেন, এ কথা সুবিদিত; তাই আমরা হালুয়া-রুটি বিতরণ করি। তিনি গোশত পছন্দ করতেন, তা-ও অবিদিত নয়। দান-খয়রাত করা ও মানুষকে খাওয়ানো একপ্রকার ইবাদত যা যে কোন সময়ে করা যায়। তবে এই রাতকে হালুয়া রুটির রাতে পরিণত করে ইবাদত থেকে গাফেল হওয়া চরম নিবুর্দ্ধিতার পরিচয়। অনেক মা-বোন তো হালুয়া রুটি বানাতে গিয়ে কোন প্রকার নফল ইবাদতও করতে পারেন না। শবে বরাতের নামে আমাদের দেশে আরও অনেক অনৈসলামিক কাজ করা হয় যেগুলো বর্জন করা জরুরি। যেমন: সুন্নত মনে করে হালুয়া রুটি বিতরণ করা, জামায়াত আকারে কোন নফল নামাজ পড়া, আতশবাজি, পটকা ফোটানো, লাইটিং করা, ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা করা, শরিয়ত বিরোধী আনন্দ-উল্লাস করা, অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘœ ঘটানো ইত্যাদি। ইদানিং আবার একশ্রেণির মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা। তাদের দাবি হলো, ‘ইসলামে শবে বরাত বলে কিছু নেই। এটা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েয।’ বাস্তব কথা হলো, এব্যাপারে বাড়াবাড়িও যেমন সঠিক নয়, তেমনি আবার ছাড়াছাড়িও সঠিক নয়। শবেবরাত সম্পর্কে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হলো, এ রাতের ফজিলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত বা জামায়াতের কোনো রূপ না দিয়ে, ওয়াজিব, ফরজের মত গুরুত্ব প্রদান না করে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন বিশিষ্ট সাহাবি মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ এই হাদিস দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা হয় তখন তার অর্থই এই হয় যে, এই সময়ে এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যতœবান হতে হবে, যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের উপর্যুক্ত হওয়া যায়। আর ওইসব গুণাহ থেকে বিরত থাকতে হবে, যার কারণে মানুষ আল্লাহ তায়ালার রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হয়। যেহেতু উপরোক্ত হাদিস এবং অন্যান্য হাদিসে অর্ধ-শাবানের রাতে ব্যাপক মাগফিরাতের ঘোষণা আছে, তাই এ রাতটি অনেক আগে থেকেই শবেবরাত তথা ‘মুক্তির রজনী’ নামে প্রসিদ্ধ। কেননা, এ রাতে গোনাহ থেকে ও গোনাহর অশুভ পরিণাম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি শবে বরাতের ফজিলতের বিষয়ে দ্বিতীয় কোনো হাদিস নাও থাকত, তাহলেও এই হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফিরাতের উপযোগি নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো। অথচ হাদিসের কিতাবগুলোতে নির্ভরযোগ্য সনদে আরও একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একবার আল্লাহর রসূল (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রসূলুল্লাহ, আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি ইন্তেকাল করেছেন কি না। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি ইরশাদ করলেন ‘এটা হলো অর্ধ-শাবানের রাত। নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ সেজদায় দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া শরিয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। এছাড়াও যে সমস্ত আমল করা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১) কুরআন তেলাওয়াত করা, ২) দরুদ শরীফ পড়া, ৩) ইস্তেগফার করা, ৪) দোয়া করা, ৫) পরের দিন রোজা রাখা, ৬) বেশী বেশী নফল নামাজ পড়া, ৭) দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আযকার ইত্যাদি করা, ৮) কবর জিয়ারত করা ও ৯) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে দোয়া করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শবে বরাতের বরকত দান করেন এবং আমাদের সমুদয় পাপ মাফ করে দেন। আমীন। (লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনী থেকে)
প্রিন্ট

আরও সংবাদ