খুলনা | শুক্রবার | ৩১ মার্চ ২০২৩ | ১৬ চৈত্র ১৪২৯

ভান্ডারিয়ায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন বিধবা জরিনা বেগম

এস এস শোহান, বাগেরহাট |
০১:৫৫ এ.এম | ১৯ মার্চ ২০২৩


আমার পাখি উড়ে গেছে। দুনিয়ায় আমার আর কিছু থাকলো না। কিসের আশায় বাঁচবো, কাকে নিয়ে বাঁচবো আমি। শনিবার বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া এলাকায় বাবার ঘরের বারান্দার খাটে বসে এভাবে বিলাপ করছিলেন পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা এলাকায় বাসচাপায় নিহত মোঃ বাদশা শেখ (১৭)’র মা বিধবা জরিনা বেগম। আর সন্তানের শোকে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
নিহত বাদশা শেখ বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জস্থ মালোপাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত দবির উদ্দিনের ছেলে। কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ রশিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেণিতে পড়তো বাদশা শেখ। ১৮ মাস বয়সে বাবাকে হারান বাদশা। সাংসারিক জটিলতা থাকায় একমাত্র সন্তান বাদশাকে নিয়ে বাবা আফছার পাইকের বাড়ির পাশে পালপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকা শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর স্বামী ছাড়াই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন অসহায় এই মা। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে এখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন এই মা। 
জরিনা বেগম আরও বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পরে কলিজার টুকরো বাদশাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। অনেক কষ্ট করে বাদশাকে বড় করেছি। বাদশা ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ওকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়েও করিনি। বাদশা সব সময় বলত “এসএসসি পাস করলেই তোমার আর কষ্ট হবে না। পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে আমার চাকুরি হয়ে যাবে। তখন তুমি শুধু শান্তি করবা”। আমার বাবা একবারে পাস করে গেছে, এখন তাকে নি আমার আর কষ্ট হবে না এই বলে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নিহত বাদশা’র মা জরিনা বেগম।
শুক্রবার বিকেলে নসিমনে করে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন মোঃ বাদশা শেখ (১৭)। এই দুর্ঘটনায় নসিমনে থাকা ১৮ জনের মধ্যে বাদশাসহ ৫ জন নিহত হন। অন্য নিহতরা হলেন, বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামের আল আমিন মলি­কের ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মলি­ক (১৭), মাঠ রাড়িপাড়া এলাকার আব্দুল কাদের মোল­ার ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী শাহিন মোল­া (১৮), মোরেলগঞ্জ উপজেলার চোমড়া এলাকার মোঃ হালিম শেখের ছেলে মোঃ সাব্বির শেখ (১৬), একই এলাকার আবুল মিনার ছেলে ইয়াসিন মিনা (১৬)। সাব্বির গোয়ালমাঠ রশিক লাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেণিতে এবং ইয়াসিন মিনা যদুনাথ স্কুল এ্যান্ড কলেজে ৯ম শ্রেণিতে পড়েন। এছাড়া এই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সিরাজুল ইসলাম শিমুল, অনিক দত্ত ও বনি আমিন নামের তিন তরুণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 
নিহত শাহিন মলি­কের মা পেয়ারা বেগম বলেন, নৌবাহিনীতে আবেদন করেছিল আমার বাবা শাহিন। বাবা’র আর চাকুরি করার স্বাদ মিটলো না। কোন মায়ের সন্তান যেন নসিমনে না ওঠে এই বলে বারবার বিলাপ করছিলেন এই মা। 
একমাত্র ভাইকে হারিয়ে কান্না থামছেনা নিহত শাহিন মোল­া‘র ছোট দুই বোনের। শাহিনের বোন সেজুতি আক্তার বলেন, আমরা দুই বোন এক ভাই। শাহিন ভাই-ই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। শোনার পর থেকেই আব্বা ও মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কোন কথাও বলছেন না। কি হবে আমাদের এই বলে আবারও কান্না শুরু করেন ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী সেজুতি আক্তার। 
এদিকে পাশাপাশি এলাকায় পাঁচ তরুণের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্থানীয়দের মাঝে। মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা পার হলেও নিহতদের পরিবারকে সরকার ও ক্যটারিং কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। নিহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। 
স্থানীয় ব্যবসায়ী ইকবাল মোল­া বলেন, যারা মারা গেছে প্রত্যেকের পরিবার খুবই অসহায়। মাত্র একশ’ টাকার জন্য এরা ক্যাটারিং সার্ভিস প্রদান করতে গিয়েছিলেন। এক কথায় একশ’ টাকা আয় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তারা। এসব পরিবারকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানাই আমরা। কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ তাছমিনা খাতুন বলেন, নিহতের পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। স্বজনহারা এই পরিবারের জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থাকবে। এ বিষয়ে আইনের মধ্য থেকে আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন উপজেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ