স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক ডাকসু ভিপি ও বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার জ্যেষ্ঠজন খ্যাত নূরে আলম সিদ্দিকী আর নেই (ইন্নালিল­াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...আমরা তো আল­াহর এবং আমরা আল­াহর কাছেই ফিরে যাবো)। 
বুধবার ভোররাত ৪টা ৩৭ মিনিটের দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্যের প্রেস সচিব কবি ও বাচিক শিল্পী অনিকেত রাজেশ তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অনিকেত রাজেশ জানান, বুধবার ভোর ৪টা ৩৭ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নূরে আলম সিদ্দিকী মারা যান। বুধবার সকাল ১০টায় তার মরদেহ হেলিকপ্টারে করে ঝিনাইদহে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজার পর বাদ আসর গুলশানের আজাদ মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা হয়। এ সময় নূরে আলম সিদ্দিকীকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এরপর সাভারে নিজের করা মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। 
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ, রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার  শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নূরে আলম সিদ্দিকী ছয় দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাÐে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন যশোর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 
সত্তরের দশকের তুখোড় এই ছাত্রনেতা ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফার একজন হিসেবে তাকে উলে­খ করা হয়। সেই সঙ্গে মুজিব বাহিনীর অন্যতম কর্ণধার ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কিংবদন্তি ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৪০ সালের ২৬ মে যশোরের ঝিনাইদহ মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন।   ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হোন। তারপর তার পিতা ঝিনাইদহের স্থানীয় আ’লীগ নেতা হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসতে শুরু করেন। ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছেড়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হোন। কিন্তু সে সময়ের ঢাকা কলেজে অধ্যক্ষ সরাসরি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
ছাত্রলীগের রাজনীতি এবং শিক্ষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় তাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে পুনরায় সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। এরপর আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন নূরে আলম সিদ্দিকী।
এরপর নূরে আলম সিদ্দিকী ৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিকা রেখে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হোন। ওই সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়কও নির্বাচিত হোন নূরে আলম সিদ্দিকী। সেই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর ভিপি পদেও নির্বাচিত হোন তিনি। এসময় বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার জ্যেষ্ঠজন হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তারপর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সত্তরের নির্বাচনে আ’লীগের বিজয় নিশ্চিত করতে দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠা ও তার রাজনৈতিক গুরু হিসেবে মূল্যায়নে নূরে আলম সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীনতাই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু করেছে। বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে অবিচল থাকায় তিনি হয়েছেন জাতির জনক। তার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা, নিজস্ব মতামতের ওপর শ্রদ্ধা এবং তা বাস্তবায়নে সংগ্রামই সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে তিনি হয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।
দেশ স্বাধীনের পরে তিনি ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। তবে ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে ঝিনাইদহ-২ আসনে পরাজিত হয়েছিলেন। তারপর দলীয় সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান একসময়ের এই কিংবদন্তি ছাত্রনেতা।
নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বর্তমানে ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।