খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

শাওয়ালের ছয় রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত

মুহাম্মদ মাহফুজুর রহমান আশরাফী |
০১:৫৪ এ.এম | ০৮ এপ্রিল ২০২৩


দিন-রাত, মাস-বছর সবই মহান আল­াহ্র। তার ভিতর “মাহে রমজান” ছিল মুমিনের ইবাদতের মাস, প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস। দীর্ঘ একটি মাস সিয়াম সাধনার পর আকাশে যখন “শাওয়াল” মাসে নতুন চাঁদের দেখা পাওয়া যায় তখন মুমিন মুসলমান রোজা ভেঙে সব চেয়ে ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদ-উল-ফিতর’ উদযাপন করে। এই ঈদ শুধু আনন্দ ও উৎসবের নয় ইবাদতও বটে।
নিম্নে আরবী শাওয়াল মাসের রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত পেশ করা হল :
কেন এই ছয় রোজা পালন : প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ) এর শরীয়তে সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছিল বলে তাফসীর গ্রন্থে উলে­খ পাওয়া যায়। অবশ্য সেই সিয়ামের ধরণ ও প্রকৃতি কেমন ছিল তা আমাদের অজানা বলা হয়ে থাকে, পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর শরীয়তেই চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়ামের বিধান ছিল। এই সিয়াম ‘সিয়াম আইয়্যামি বীজ’ নামে খ্যাত। প্রসিদ্ধ তাফসীরবিদ দাহহাক বর্ণনা করেছেন, হযরত নূহ (আঃ) থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়ামের বিধান ছিল। শেষকালে রমজানের মাসব্যাপী সিয়ামের বিধান দেয়া হলে মাসিক তিন দিনের সিয়াম রহিত হয়। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)। তাহলে হিসেবে দেখা গেল, পূর্বের নবীদের উপর ১২*৩=৩৬ টি রোজা ফরজ ছিল, আর আমরা শুধু রমজান মাসে ৩০টি রোজা পালন করি, আর যদি এই শাওয়াল মাসে এই বরকতময় ফজিলত পূর্ব ছয়টি রোজা পালন করি (৩০+৬) তাহলে মোট ৩৬টি রোজা পালন করা হবে। অন্য আর একটি হিসেবে দেখা যায়, রমজানের ৩০টি রোজার সঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি রোজা যুক্ত হলে মোট রোজার সংখ্যা হয় ৩৬টি। আর প্রতিটি পূণ্যের জন্য ১০ গুণ পুরস্কারের কথা উলে­খ রয়েছে আল কুরআনে। তাহলে ৩৬টি রোজার ১০ গুণ হলো ৩৬০টি রোজার সমান। (পুরস্কারের দিক থেকে) অর্থাৎ সারা বছর রোজার সমান হবে। 
শাওয়ালের ছয় রোজার গুরুত্ব : যদিও শাওয়াল মাসের রোজা রাখা সুন্নত কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখার মাধ্যমে রমজানের রোজা আদায়ের তাওফিকের শুকরিয়া আদায় করা হয়। যখন কোনো বান্দার আমল আল­াহ তায়ালা কবুল করেন তখন তাকে অন্য একটি নেক আমলের তাওফিক দেন। সুতরাং এ রোজা গুলো রাখতে পারা রমজানের রোজা কবুল হওয়ার লক্ষণ। এ রোজা গুলো রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সাওয়াব পাওয়া যায়। আল­াহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেও এই রোজাগুলো রাখতেন এবং সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) দের রাখার নির্দেশ দিতেন। মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল­াহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল অতঃপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল। হযরত সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল­াহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেন, রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর শাওয়ালের ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং এ হলো এক বছরের রোজা। (নাসায়ি) সূরা আনয়ামের ১৬০নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি একটি সৎ কাজ করল সে দশ গুণ সওয়াব পাবে। এ হিসেবে সে ব্যক্তি রমজানের এক মাস রোজা রাখল সে ১০ মাস রোজা রাখার সওয়াব পাবে। আর ছয়টি রোজার ১০ গুণে ৬০ দিন। অর্থাৎ দুই মাস। আর এ দুই মাস মিলে ১২ মাস রোজার সওয়াব। হযরত উবাইদুল­াহ ইবনে মুসলিম আল কুরাইশি (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদিন রাসূল­াহ্কে (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলুল­াহ! আমি কি সারা বছর রোজা রাখতে পারব ? তিনি বললেন, তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে। কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখো এবং রমজান পরবর্তী শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখো তাতেই সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে। (তিরমিযি)
রমজান পরবর্তী কাজ : রমজান মাস বিদায়ের সাথে সাথে তার ইবাদতও বিদায় হয়ে যায়, আসলে এটি মোটেও ঠিক নয়, আমাদের আল­াহর নির্দেশ অনুযায়ী শরীয় বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল­াহর সাথে বান্দার শুধু এক মাসের সম্পর্ক নয়, বরং সারা জীবনের জন্য এই সম্পর্ক ও ভালোবাসা। তাই রমজান মাস ছিল ইবাদতের প্রশিক্ষণের মাস, কারণ এ মাসে গুণা থেকে বাঁচার জন্য মুমিনরা ব্যস্ত থাকে। রমজান চলে গেলেও কিছু আমলের মাধ্যমে রমজানের প্রশিক্ষণ ধরে রাখা প্রয়োজন। নিম্নে কিছু কাজ তুলে ধরা হলো- (১) রমজানের নফল বা অতিরিক্ত ইবাদত গুলো চলমান রাখা, যেমন- ধূমপান না করা, দান-ছদকা করা, জিকির করা, কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। (২) ছুটে যাওয়া রোজাগুলোর কাজা আদায় করা। কাজা হলো বকেয়া আদায়। অসুস্থ ব্যক্তি ও মুসাফিরের জন্য রমজানের রোজা ছাড়ার অনুমতি আছে। মুসাফির এবং অসুস্থ ব্যক্তির মতো হায়েজ ও নেফাসগ্রস্ত নারীর জন্যও রোজা ছাড়ার অনুমতি আছে। আশঙ্কা থাকলে গর্ভবর্তী ও দুগ্ধদানকারী নারীরও রোজা ছাড়ার অনুমতি আছে। মহান আল­াহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটিতে (রমজানে) উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির হয়, সে অন্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে, আল­াহ তোমাদের জন্য সহজটাই চান, কঠিন করতে চান না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)। এসব কারণে যারা রমজানের রোজা ছেড়েছেন তাদের সেই ছুটে যাওয়া রোজাগুলো আদায় করে নেওয়ার সবচেয়ে উপযোগি সময় হলো। রমজান-পরবর্তী শাওয়াল মাস। বিলম্বে আদায় জায়েজ হলেও যত সম্ভব তাড়াতাড়ি আদায় করে নেওয়া উচিত। (৩) রমজানের কাফফারা আদায় করা। কাফফারা হলো জরিমানা। মুসাফির এবং অসুস্থ ব্যক্তির মতো যাদের ইসলাম রোজা ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে, তারা ব্যতীত অন্য কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার বা স্ত্রী সন্তোগের মাধ্যমে একটি রোজাও ছাড়েন তাহলে এর জন্য কাজা ও কাফফারা উভয়ই আদায় করতে হয়। রোজা কাফফারা হলো বিরতিহীনভাবে ৬০টি রোজা রাখা। ৬০ টি রোজা যেমন শর্ত তেমনি তা লাগাতার হওয়ার শর্ত। তাই যদি কেউ কাফফারা আদায় করতে গিয়ে ৬০তম দিনেও অসুস্থ হয়ে সে রোজা ভেঙে ফেলে তবে তাকে আবার প্রথম থেকে কাফফারা আদায় শুরু করতে হবে। রোজা রাখতে অক্ষম হলে ৬০ জন মিসকিনকে দু’বেলা খানা খাওয়াতে হবে। অথবা প্রতি মিসকিনকে এক ফিতরা পরিমাণ খাদ্য বা অর্থ দিয়েও কাফফারা আদায় করা যাবে। কাজা ও কাফফারা আদায় রমজান-পরবর্তী শাওয়াল মাসেই অবিলম্বে শুরু করা উচিত। 
পরিশেষে বলতে চাই, এছাড়াও আমাদের সমাজে কিছু লোকের ধারণা, ছয় রোজা শুধু মহিলারা রাখবে, পুরুষ রাখবেনা, এ ধারণা সঠিক নয়, এ ইবাদত অর্থাৎ ছয় রোজা রাখা পুরুষ-মহিলা সবার জন্য সুন্নত। রমজানের আসল শিক্ষার বাস্তবায়ন করে যেমন, আত্মসংযম, সততা, সত্যনিষ্ঠা, আল­াহভীতি, আল­াহর গোলামী ও আনুগত্য এবং নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার যে অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তা সারা বছর পালন করে, বিশেষ করে ফজিলত পূর্ণ মাস ‘শাওয়াল’ মাসের ছয়টি রোজা আদায় করে, আরো একবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মহান আল­াহ তালায়া আমাদের তাওফিক দান করুক। আমিন ছুম্মা আমিন\
লেখক: মুফাসসিরে কোরআন ও সিনিয়র প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, মাতৃভাষা ডিগ্রী কলেজ। শরণখোলা, বাগেরহাট।

 

্রিন্ট